মাছ ধরতে গিয়ে ২ মাস নির্জন দ্বীপে আটকা ১৫ জেলে, অতপর…

সমুদ্রে মাছ ধরতে গত ২৭ নভেম্বর দক্ষিণ ভারত উপকূল থেকে রওনা দেন এডিসন আর অগাস্টিন। সঙ্গে ছিল আরও ১৪ জন জেলে। যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ফিরে এসে পরিবারের সাথে কাটাবেন বড়দিন। তার পর কেটে গেছে অনেক দিন। কিন্তু কোনো খোঁজ মিলছিলো না তাদের।

বড়দিন আসে। চলেও যায়। তখনই চিন্তা বাড়তে থাকে পরিবারের। তারা ধারনা করে নেন কোনও ঘূর্ণিঝড়ে হয়তো নৌকা উল্টে মৃত্যু হয়েছে জেলেদের সবার। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে গত ২ জানুয়ারি ঘরে ফেরেন এই মৎস্যজীবীরা। তারাই শোনান সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা।

ভারতীয় বাংলা গণমাধ্যম আনন্দবাজারকে অগাস্টিনর জানান, তামিলনাড়ুর থেঙ্গাপত্তনম বন্দর থেকে ক্রিশা মোল নামের একটি কাঠের নৌকায় রওনা হয়েছিলেন ১৫ জন মৎস্যজীবীর দলটি। রওনা হওয়ার পর সপ্তম দিন নৌকার ইঞ্জিন ভেঙে যায়। তারপর গভীর সমুদ্রের দিকে এগোতে থাকে। এ ভাবে পাঁচ দিন চলার পর শ্রীলঙ্কার মৎস্যজীবীদের একটি নৌকা অগাস্টিনদের দেখতে পায়।

শ্রীলঙ্কার মৎস্যজীবীদের নৌকাটি অগাস্টিনদের নৌকাটিকে টেনে অগভীর সমু্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে জলের গভীরতা ছিল ২৬ ফুট। ওই জায়গায় গিয়ে নোঙর ফেলে নৌকাটি। কিন্তু শ্রীলঙ্কার মৎস্যজীবীদের নৌকা ভারতীয় জলসীমানায় প্রবেশ করতে পারে না। তাই সেখানকার মৎস্যজীবীরা পরামর্শ দেন, অন্য ভারতীয় মৎস্যজীবীদের নৌকাকে ওয়্যারলেস বার্তা পাঠাতে। অনেক চেষ্টা করে তিন দিন পর একটি ভারতীয় নৌকা অগাস্টিনদের বার্তার জবাব দেয়। কিন্তু সেই নৌকার ইঞ্জিন ততটা শক্তিশালী নয়। সেটি ক্রিশা মোলের মতো বড়সড় নৌকা টানতে ব্যর্থ হয়।

ক্রিশা মোলের মালিকও ছিলেন নৌকায়। তিনি গিয়ারবক্সটিকে সাহায্যকারী নৌকায় তুলে দেন। আর বাকি মৎস্যজীবীরা সিদ্ধান্ত নেন, নোঙরটিকে সেখানেই ফেলে যাবেন। এর ফলে নৌকা হালকা হয়ে যাবে। ফলে সাহায্যকারী নৌকাটি অনায়াসে ক্রিশা মোলকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখানেই বিপত্তির শেষ নয়। মাঝসমুদ্রে একটি দড়ি ছিঁড়ে যায়। তিন দিন পর, ১৯ ডিসেম্বর ঝড়ে আরও একটি দড়ি ছিঁড়ে যায়। ফলে সাহায্যকারী নৌকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ক্রিশা মোল।

নিমাস নামে এক মৎস্যজীবী বলেন,‘তখন ঈশ্বরকে ডাকা ছাড়া তখন কোনও উপায় ছিল না।’’ জিপিএসে দেখা যায়, ২৯ নটিক্যাল মাইল দূরে রয়েছে একটি দ্বীপ। ব্রিটিশ ভারত মহাসাগরের এলাকার অন্তর্ভুক্ত।

নৌকার সঙ্গেই ছিল ডিঙি নৌকা। তাতে খাবার চাপিয়ে ওই দ্বীপের দিকেই এগোতে থাকেন ৯ জন। ঠিক হয় বাকিদের পরে নিয়ে আসা হবে। বাকি পাঁচ জন মৎস্যজীবী ক্রিশা মোলেই অপেক্ষা করছিলেন। সাত জনকে ওই দ্বীপে রেখে দু’জন মৎস্যজীবী বাকি পাঁচ জনকে নিতে আসেন গভীর সমুদ্রে। তত ক্ষণে ক্রিশা মোল স্রোতে ভেসে গিয়েছে। অনেক খুঁজেও ক্রিশা মোলকে দেখতে পাচ্ছিলেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজ করে ওই পাঁচ জনকে ডিঙিতে চাপিয়ে দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হন বাকি দু’জন।

দ্বীপে পৌঁছে নতুন সমস্যায় পড়লেন মৎস্যজীবীরা। খাওয়ার মতো ১০ দিনের রেশন রয়েছে। কিন্তু পানীয় নেই। সমুদ্রের পানি দিয়েই তাঁরা রান্না শুরু করলেন। দ্বীপে ছিল অনেক নারকেল গাছ। সেখান থেকে নারকেল পেরে সেই পানি খেয়েই কাটতে লাগল এডিসন আর অগাস্টিনদের।
পাঁচ দিন পর, ২৭ নভেম্বর খুব দূরে তাঁরা একটি ব্রিটিশ জাহাজ দেখতে পান। মৎস্যজীবীরা গাছে লাল কাপড় বেঁধে নাড়তে থাকেন, যাতে দূরের জাহাজ তাঁদের দেখতে পারেন। দুই ঘণ্টা পর ওই জাহাজ থেকে পানীয় জল আর ফলের ঝুড়ি নিয়ে দ্বীপে দেখা করতে আসেন দুইজন মৎস্যজীবী। এরপর দ্বীপে আটকে থাকা মৎস্যজীবীদের ডিঙিতে চাপিয়ে নিজেদের জাহাজে নিয়ে যান।

জাহাজে গিয়ে প্রায় এক মাস পর গোসল করেছিলেন ওই ১৫ জন মৎস্যজীবী। পেট ভরে খেয়েছিলেন। এর পর ২ জানুয়ারি মৎস্যজীবীদের ভিঝিনজাম বন্দরে এনে ভারতীয় উপকূলরক্ষীদের হাতে তুলে দেন ব্রিটিশ জাহাজের কর্মীরা। এর পর ভারতীয় উপকূলরক্ষী বাহিনী ১৫ জন মৎস্যজীবীর নাম, পরিচয় খতিয়ে দেখে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , ,

oceantimesbd.com