২ হাজার কৃষকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে সেই ‘অভিশপ্ত’ বাওয়াছড়া

দুই হাজার কৃষকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে বাওয়াছড়া সেচ প্রকল্প

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রায় দুই হাজার কৃষকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে বাওয়াছড়া সেচ প্রকল্প। পানির অভাবে এক সময় চাষাবাদ করতে না পারা কৃষকরা এখন সারা বছরই ধান, রবি শষ্য এবং শাক-সবজি উৎপাদন করছে। এতে স্বাবলম্বী হয়েছে এলাকার প্রান্তিক কৃষক।

একসময় বারোমাসি বাওয়াছড়া ছিল এলাকার মানুষের গলার কাঁটা। এই ছরার পানিতে বর্ষা মৌসুমে তলিয়ে যেত ফসলি জমি, বসতবাড়ি ও রাস্তা-ঘাট। তাই এ ছরাকে ‘অভিশপ্ত’ মনে করতেন এলাকার মানুষ। সেই বাওয়াছড়া এখন আর অভিশাপ নয়। ছরার উৎসমুখে তৈরি করা বাঁধ বদলে দিয়েছে সব কিছু। বওয়াছড়া প্রজেক্টে ধারণ করা পানি এখন এলাকার কৃষকের ভাগ্যলক্ষী। ১৫ নম্বর ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার একর অনাবাদি জমিতে এখন চাষ হয় এই পানি দিয়ে।

বাওয়াছড়া সেচ প্রকল্পের উপকারভোগী ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মধ্যম ওয়াহেদপুর গ্রামের কৃষক বিকাশ ভৌমিক বলেন, বাওয়াছড়া প্রকল্পের ফলে বর্তমানে আমরা পাহাড়ি ঢলের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। আমাদের এলাকার কৃষকরা প্রতিবছর সময়মতো প্রকল্পের পানি দিয়ে বোরো, আমনসহ বারোমাসি শাক-সবজি চাষ করছে।

দক্ষিণ ওয়াহেদপুর এলাকার কৃষক আলা উদ্দিন, রুহুল আমিন, ননাই চন্দ্র নাথ বলেন, বাওয়াছড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে আমাদের এলাকায় শত শত ঘরবাড়ি বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে থাকতো। তখন এলাকার জনসাধারণ এই ছরাকে অভিশাপ মনে করতো। কিন্তু এখন এই লেক এলাকার অনেক কৃষকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।

বাওয়াছড়া সেচ প্রকল্প (ছবি: ওশান টাইমস)

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৫ সালে উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের ৩, ৫, ৬, ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দুই হাজার কৃষককে নিয়ে বাওয়াছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি (পাবসস) লিমিটেড গঠিত হয়। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, নিজেদের সঞ্চিত অর্থ থেকে কৃষকদের কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয় সমিতি থেকে। বাওয়াছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি পাহাড়ের পাদদেশে একটি বাঁধ নির্মাণ ও স্লুইচ গেইট স্থাপনের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) উপজেলা অফিসে যোগাযোগ করেন। এলজিইডি ২০০৫ সালে ৬০ শতক জমি অধিগ্রহণ করে। ৬০ শতক জমিতে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় ক্ষুদ্রাকার পানি সেচ প্রকল্পের আওতায় এলজিইডি বারোমাসি বাওয়াছড়ার মুখে বাঁধ নির্মাণ ও পানি আটকানোর জন্য রেগুলেটর স্থাপন করে।

বাওয়াছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিডেট (পাবসস) এর সভাপতি আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া ওশান টাইমসকে বলেন, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডে আগে বোরো চাষ হতো না। শুস্ক মৌসুমে পানি সংকটে শাক-সবজি চাষ করা যেতো না। বাওয়াছড়া পানি প্রকল্পের কারণে বিগত ১৭ বছর ধরে প্রায় ২০০০ একর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। মূলত সমিতি পানি ব্যবস্থাপনার কাজ করেন।

বাওয়াছড়া সেচ প্রকল্পের পানিতে সেজেছে ফসলের মাঠ

সমিতির নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সেকান্দার মিয়া বলেন, এখন বছরের যে কোন সময় এই এলাকায় গেলে অনাবাদি জমি চোখে পড়বে না। এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বাওয়াছড়া সেচ প্রকল্পের কারণে।

তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটি স্থাপনের পর ৩০ মিটার লেকের গভীরতা ছিল। পাহাড়ি বালু ও মাটি ভরাট হয়ে এখন ১০ মিটার ভরাট হয়ে গেছে। এতে আগের মতো বেশি পানি সংরক্ষণ হচ্ছে না। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লেকটি সংস্কারের দাবী জানাচ্ছি।

জানা গেছে, লেকে বাওয়াছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিঃ থেকে কার্প জাতীয় মাছের চাষ করা হচ্ছে। যেগুলো এখন প্রায় ৩-৫ কেজি ওজনের হয়ে গেছে। ১০ একর বিশিষ্ট লেকের স্বচ্ছ নীলজলরাশি মুগ্ধ করবে যেকোন ভ্রমণপিয়াসুকে। ইতমধ্যে বারৈয়ঢালা ন্যাশনাল পার্ক বাওয়াছড়া ঝরনাকে ইজারা দিয়েছে।

বাওয়াছড়ার পানিতে সেজেছে ফসলের মাঠ

এলাকার কৃষি উন্নয়ন ও জলবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে ২য় ক্ষুদ্রাকার সেচ প্রকল্পের আওতায় ২০০৫ সালে বাস্তবায়ন হয় বাওয়াছড়া সেচ প্রকল্প। এরপর থেকে এলাকার কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে ভূমিকা রেখে আসছে এ প্রকল্পটি। লেকটি গত ১৭ বছর ধরে কৃষিকাজের চাহিদা জন্য পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে।

মিরসরাই উপজেলা সহকারী কৃষ কর্মকর্তা কাজী নুরুল আলম ওশোন টাইমসকে বলেন, ‘বাওয়াছড়া সেচ প্রকল্পের কারণে ২০০০ হাজার অনাবাদি জমিতে এখন চাষাবাদ হচ্ছে। প্রতি বছর আমরা লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাচ্ছি। লেকে সংরক্ষিত পানি দিয়ে রবিশষ্য সিসিঙ্গা, ঝিঙ্গা, লাউ, বরবটি, ধুন্দল, চিনাবাদাম চাষ করা হচ্ছে। প্রকল্পের পানি দিয়ে বোরো চাষ, আউশের বীজতলা প্রস্তুত, রবিশষ্য চাষের আওতায় এসেছে। উৎপাদন ভালো হওয়ায় কৃষকরাও খুশি।’

মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জসীম উদ্দিন বলেন, এক সময় এই বাওয়াছড়া এলাকার মানুষের জন্য অভিশাপ ছিল। এখন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এই ছরা আশির্বাদ হয়েছে। এছাড়া বাওয়াছড়া একটি পর্যটন কেন্দ্র। সরকার ইজারা দিয়ে এখান থেকে রাজস্ব পাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , ,

oceantimesbd.com