তিমির বমির দাম কেন লাখ লাখ ডলার?

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ ইয়েমেনে একদল জেলের জীবন হঠাৎ করেই বদলে গেছে। তিমি মাছের পেটের ভেতরে পাওয়া দুর্লভ এক জিনিস বদলে দিয়েছে তাদের ভাগ্য। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও তারা মাছ ধরতে গিয়েছিল এডেন উপসাগরে। একপর্যায়ে তারা সমুদ্রের পানিতে একটি মরা স্পার্ম তিমি ভাসতে দেখে। তখনো তারা ভাবতে পারেনি যে এর পেটের ভেতরে আছে মহামূল্যবান এক পদার্থ।

মাছটি থেকে এমন এক দুর্গন্ধ আসছিল যে তাদের সন্দেহ হয় এর ভেতরে কিছু একটা আছে। তখন জেলেরা তিমি মাছটিকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে আসে। পেট কেটে এর ভেতরে এমন একটি জিনিস দেখতে পায়, যা তারা কল্পনাও করতে পারেনি।

মূল্যবান এই জিনিসটির নাম অ্যাম্বারগ্রিস, যার বাজার মূল্য ১৫ লাখ ডলারের বেশি।

অ্যাম্বারগ্রিস কী?
স্পার্ম হোয়েলের পরিপাকতন্ত্রে নিঃসৃত রস জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে তৈরি হয় অ্যাম্বারগ্রিস। বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিজের পরিপাকতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য সামুদ্রিক এই প্রাণীটি এ ধরনের রস নিঃসরণ করে থাকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, স্পার্ম হোয়েল খাদ্য হিসেবে অন্যান্য যেসব সামুদ্রিক প্রাণী বা মাছ খায় সেগুলোর হাড়গোড়সহ বিভিন্ন ধারালো ও শক্ত অংশ যাতে তার নিজের পরিপাকতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ফুটো করে ফেলতে না পারে এজন্য তিমি এই রস নিঃসরণ করে, যা পরে পেটের ভেতরে জমাট বেঁধে যায়।

তিনি বলেন, পেটের ভেতরে নিঃসৃত এই রস সাধারণত এটা ছোট ছোট লাম্পে জমাট বাঁধে ও তিমির মলের সাথে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সেই রস জমতে জমতে যখন বড় আকার ধারণ করে তখন সেটা পায়ুপথ দিয়ে বের হতে পারে না।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, এরকম পরিস্থিতিতে স্পার্ম হোয়েল তার পেটের ভেতরে জমাট বাঁধা রস মুখ দিয়ে বের করে দেয়। এজন্য অ্যাম্বারগ্রিসকে হোয়েলের বমি হিসেবেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

স্পার্ম হোয়েলের পায়ুপথ কিম্বা মুখ দিয়ে নির্গত এই কঠিন কিন্তু মোমের মতো দাহ্য বস্তুটিই অ্যাম্বারগ্রিস।

কোথায় পাওয়া যায়
সব স্পার্ম হোয়েলের পেটের ভেতরে এই অ্যাম্বারগ্রিস তৈরি হয় না। কিছু কিছু তিমির ভেতরে এটা পাওয়া যেতে পারে। স্পার্ম হোয়েল ছাড়া অন্য কোনো তিমি মাছের পেটে এই অ্যাম্বারগ্রিস তৈরি হয় না।

সমুদ্র বিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, বিশ্বে যতো স্পার্ম হোয়েল আছে তার এক থেকে দুই শতাংশের মধ্যে ব্যবহারযোগ্য অ্যাম্বারগ্রিস আছে। অর্থাৎ সমুদ্রে যদি ১০০টি স্পার্ম হোয়েল থাকে তাহলে তার একটি কি দু’টির মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যাম্বারগ্রিস থাকতে পারে।

কেন এত মূল্যবান
ইয়েমেনের জেলেরা এডেন উপসাগরে মৃত একটি তিমি মাছের পেটের ভেতরে যেটুকু অ্যাম্বারগ্রিস পেয়েছে সেটা তারা বিক্রি করেছে ১৫ লাখ ডলারে।

এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে তারা খুব খুশি। হঠাৎ করেই এভাবে এতো অর্থ পেয়ে যাবে সেটা তারা কখনো কল্পনাও করেনি। তাদের কাছে এটা স্বপ্নের মতো।

অ্যাম্বারগ্রিস বিক্রি করে পাওয়া অর্থ জেলেরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে, যা দিয়ে কেউ বাড়ি ও গাড়ি কিনেছে। কেউ কেউ বিয়ে করে সংসার শুরু করার পরিকল্পনা করছে। কিছু অর্থ বিলিয়ে দেয়া হয়েছে গরিব মানুষের মধ্যে।

বাজারে এক কেজি অ্যাম্বারগ্রিসের দাম প্রায় ৫০ হাজার ডলার। এতো দামি হওয়ার কারণে এটিকে প্রাকৃতিক স্বর্ণ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।

এর দাম এত বেশি হওয়ার পেছনে একটি কারণ হচ্ছে এর দুষ্প্রাপ্যতা। সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এটি অতি দুর্লভ সামগ্রী। মাত্র এক থেকে দুই শতাংশ স্পার্ম হোয়েলের মধ্যে এটি পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় যে সারা বিশ্বে মাত্র ৩০০ তিমির মধ্যে এই অ্যাম্বারগ্রিজ থাকতে পারে। এ ছাড়াও এই ৩০০ তিমি জীবিত। এর ভেতর থেকে তো অ্যাম্বারগ্রিস নিয়ে আসা যাচ্ছে না। হয় তাকে মারতে হবে, অথবা মরে যাওয়ার পর তার পেটের ভেতর থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এ কারণেই এর প্রতি কেজির মূল্য দাঁড়িয়েছে লাখ লাখ টাকা।

এটি মূল্যবান হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো এর বিশেষত্ব। অনেক দেশে এই অ্যাম্বারগ্রিসের বেচা-কেনা ও এর যেকোনো ধরনের ব্যবহার নিষিদ্ধ। কালোবাজারে বিক্রি হওয়ার কারণেও এর দাম আরো বেড়ে যায়।

কী কাজে লাগে?
পারফিউম বা সুগন্ধি শিল্পে এই অ্যাম্বারগ্রিস ব্যবহার করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, কস্তূরী বা মৃগনাভির টোন নিয়ে আসা ও সুগন্ধিকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য অ্যাম্বারগ্রিজ ব্যবহার করা হয়। বিকল্প হিসেবে রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে যাওয়ার পরেও নামিদামি পারফিউমের ব্র্যান্ডগুলো এখনো তাদের বিশেষত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রাকৃতিকভাবে সংগৃহীত অ্যাম্বারগ্রিসের ওপরেই নির্ভর করে।

এ কারণে সুগন্ধি প্রস্ততকারক কোম্পানিগুলোর কাছে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

ইয়েমেনের জেলেরা যখন সমুদ্রে ভাসতে থাকা মৃত তিমি মাছটির কাছে পৌঁছান তখন সেখান থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ আসতে থাকে। মাছটিকে তীরে নিয়ে এসে তারা এর পেট কেটে তার ভেতর থেকে অ্যাম্বারগ্রিস বের করে আনেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাজা অ্যাম্বারগ্রিস থেকে বাজে গন্ধ নির্গত হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি যতোই পুরনো হতে থাকে ততোই এটি সুগন্ধি ছড়াতে থাকে।

স্পার্ম হোয়েলের সংখ্যা
যে স্পার্ম হোয়েলের পেটের ভেতরে অ্যাম্বারগ্রিস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেটি বিপন্নপ্রায় প্রজাতির এক প্রাণী।

স্পার্ম হোয়েল (sperm whale) বা শুক্রাণু তিমি বন্যপ্রাণী আইনের (Wildlife Act) অধীনে সংরক্ষিত একটি বিপন্ন প্রজাতি

বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে বর্তমানে সারা বিশ্বে তিন লাখের মতো স্পার্ম হোয়েল আছে। কিন্তু তিমি মাছের শিকার শুরু হওয়ার আগে ১১ লাখ স্পার্ম হোয়েল ছিল বলে তাদের ধারণা। তিমি শিকারের ফলে স্পার্ম হোয়েলের সংখ্যা কমতে কমতে এখন ২৫ ভাগে নেমে এসেছে।

তবে সাম্প্রতিককালে তিমি শিকারের ওপর বিভিন্ন ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ ও নজরদারি বাড়ানোর কারণে এর সংখ্যা কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনই এই স্পার্ম হোয়েলের সংখ্যা খুব একটা কমছে না।

প্রথমত খাদ্য হিসেবে তিমি মাছ শিকার করা হয়। এই প্রাণীটির বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাড়াও তেল ও চর্বির বাণিজ্যিক ব্যবহারও তিমি শিকারের আরো একটি কারণ। অ্যাম্বারগ্রিসের সন্ধানেও অনেক তিমি শিকার করা হয়ে থাকে।

সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আগে তিমি মাছের অনেক মূল্যবান জিনিসের বিকল্প হিসেবে সিনথেটিক রাসায়নিক উপাদান ছিল না। এসব জিনিসের জন্য তিমি শিকার শুরু হয়। এখন এর সবগুলোরই বিকল্প আছে। কিন্তু এখনো কিছু কিছু তিমি শিকার হচ্ছে।

বঙ্গোপসাগরে তিমি
বঙ্গোপসাগরে স্পার্ম হোয়েল আছে কি না এবিষয়ে নিশ্চিত করে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সারা বিশ্বের মহাসমুদ্রে যেহেতু এই তিমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাই বঙ্গোপসাগরেও এটি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে স্পার্ম হোয়েল দেখা গেছে এরকম কোনো স্পটিং রিপোর্টের কথা জানা নেই। উত্তর বঙ্গোপসাগরে স্পার্ম হোয়েল আসবে না। কারণ ১০০০ মিটারের কম গভীর সমুদ্রে স্পার্ম হোয়েল বিচরণ করে না।

সারা বিশ্বে মহাসমুদ্রের আয়তন প্রায় ৩৬২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। আর বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশের আয়তন মাত্র ১১৮ বর্গ কিলোমিটার। এই হিসেবে সারা বিশ্বের স্পার্ম হোয়েলকে যদি সমানভাবে বণ্টন করা হয় তাহলে বঙ্গোপসাগরেও কিছু স্পার্ম হোয়েল ঢোকার কথা। বঙ্গোপসাগরের গভীরতা যেখানে আড়াই থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার সেখানে স্পার্ম হোয়েল আসতেও পারে। সারা বিশ্বে যেহেতু তিন লাখের মতো স্পার্ম হোয়েল আছে, ঘনত্বের বিচারে বঙ্গোপসাগরে ১০০ থেকে ১৫০টি স্পার্ম হোয়েল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অংশে গভীরতা কম হওয়ার কারণে সেখানে স্পার্ম হোয়েলের আসার সম্ভাবনা খুবই কম।

সূত্র : বিবিসি

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , ,

সব সংবাদ

For add

oceantimesbd.com