বাংলাদেশে সুনীল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনা

সমুদ্র পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সম্পদের উৎস। সমুদ্রের বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশের সঞ্চিত সম্পদকে কাজে লাগানোর অর্থনীতিই হচ্ছে সুনীল অর্থনীতি, যা বর্তমান সময়ের উদীয়মান অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুনীল অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করা, সামাজিক পুঁজি সৃষ্টি করা, আয় বাড়ানো এবং সর্বোপরি পরিবেশে সঞ্চয়— বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা।

সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ যেমন মানুষের খাওয়ার চাহিদা মেটায় তেমনি সমুদ্রের প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ। বালি, লবণ, পটাসিয়াম, কোবাল্ট, ম্যাগনেসিয়াম, কপার ইত্যাদি মূল্যবান ধাতুর আধার হিসেবে ব্যবহূত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্র যোগাযোগ ও পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে। এছাড়া স্থলভাগের তুলনায় জলভাগের পরিমাণ বিশাল, আর এ বিশাল অঞ্চলে তেল ও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। তাই আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে আহরণের ক্ষেত্র হিসেবে মানুষ সমুদ্রের দিকে ঝুঁকছে।

বর্তমান বিশ্বে ক্রমেই সুনীল অর্থনীতি জনপ্রিয় হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও সুনীল অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশ একক কর্তৃত্ব লাভ করেছে এবং তার ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আশা করা যায়, দক্ষতার সঙ্গে এ বিশাল সামুদ্রিক অঞ্চলকে কাজে লাগাতে পারলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও ভিশন-২০৪১ অর্জনে সুনীল অর্থনীতি বিশেষ অবদান রাখবে।

আমাদের সমুদ্র অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৫০০ প্রজাতির মাছ এবং চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক, অক্টোপাস, ডলফিন, তিমি, হাঙ্গরসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী। সামুদ্রিক মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে, মূল্যবান ওষুধ, ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করা হচ্ছে, যা প্রতিনিয়ত নতুন ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে দেশের জন্য প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ সম্পদ—তেল, গ্যাস, চুনাপাথর প্রভৃতি। রয়েছে মূল্যবান খনিজ বালি। এছাড়া প্লাটিনাম, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ ক্রাস্ট, তামা, সিসা, জিঙ্ক এবং কিছু পরিমাণ সোনা ও রূপা দিয়ে গঠিত সালফাইডের অস্তিত্ব রয়েছে। সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে মিথেন হাইড্রেটের সন্ধান পাওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে, যার বেশ কিছু ইতিমধ্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০০ নটিক্যাল মাইল। কিন্তু বাংলাদেশের ট্রলারগুলো উপকূল থেকে ৩৫-৪০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই মাছ আহরণ করে। আরো বিস্তৃত পরিসরে যদি কাজ করা যায়, তবে সমুদ্র অর্থনীতি সুদৃঢ় করার বিশেষ সুযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বের যেসব দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে বাংলাদেশ।

এখন দরকার সঠিক ও সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা। জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন হলো একটি জরিপ কার্যক্রম দ্রুত শুরু করা, যেখান থেকে সঠিক তথ্য মিলবে। প্রয়োজনে বিদেশি দক্ষ সংস্থার পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এজন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্র অর্থনীতিকে যারা সফলভাবে কাজে লাগাতে পারছে, এমন দেশের সহায়তায় নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে।

সমুদ্র-নির্ভর শিল্পের উন্নয়ন ও বিস্তারে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। সমুদ্র বিজয়ের পর পরই ২০১৪ সালে সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করা হয়েছে, তা সক্রিয় করতে হবে। সমুদ্রসম্পদ সুরক্ষায় ২০১৯ সালে যে ‘মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট’ করেছে সরকার, তা জোরদার করতে হবে। বিদেশিদের বিনিয়োগে আহ্বান করার পাশাপাশি দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্লু ইকোনমি ঘিরে শিল্প প্রতিষ্ঠায় আকৃষ্ট ও আগ্রহী করে তুলতে হবে।

আশার কথা এই যে, বর্তমানে সরকার সুনীল অর্থনীতির সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার ওপর বিশেষ নজর দিচ্ছে। সমুদ্র গবেষণা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য সরকার মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। সমুদ্র অর্থনীতির বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছে। সুনীল অর্থনীতিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন-জাপান। হাতে নেওয়া হয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ এবং তৈরি করা হচ্ছে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় যেসব অনাবিষ্কৃত সমুদ্রসম্পদ আছে, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সেগুলোর সংগ্রহ এবং টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, কারণ কোনো সম্পদই সীমাহীন নয়! সামুদ্রিক সম্পদকে দক্ষতার সঙ্গে আহরণ ও কাজে লাগাতে সমুদ্র বিষয়ে পরিকল্পনা, জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় ক্ষমতা বিকাশের জন্য নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া এবং এ সম্পদ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য কার্যকর কর্মপন্থা এখন থেকেই নির্ধারণ করা অতীব জরুরি। সঠিক পথে এগোনো গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে সুনীল অর্থনীতি।

লেখক: মুমতা হেনা মীম, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , ,

oceantimesbd.com