সমুদ্রসীমা বিজয় দিবস

সাগরতলের জ্বালানিসম্পদের হদিস মেলেনি ১১ বছরেও

* মিয়ানমার গ্যাস উত্তোলন করে রপ্তানি করছে
* বিপুল গ্যাস সম্পদের খোঁজ পেয়েছে ভারত
* বাংলাদেশ কেবল মাল্টিক্লায়েন্ট জরিপের কাজ শুরু করেছে

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তির ১১ বছরেও সমুদ্রে কী পরিমাণ তেল-গ্যাস পাওয়া যেতে পারে, তার প্রাথমিক তথ্য জানতে পারেনি বাংলাদেশ। যার কারণে গভীর সমুদ্রে বিপুল তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও আজও তা অজানাই রয়েছে।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গত জানুয়ারি মাসে বহুমাত্রিক জরিপ মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ শুরু করেছে আন্তর্জাতিক কম্পানি টিজিএস-স্লামবার্জার। প্রতিষ্ঠানটি পেট্রোবাংলার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে জরিপের কাজ শুরু করেছে। বিদেশি কম্পানিকে আকৃষ্ট করতে সংশোধন করা হচ্ছে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি)। আগামী দুই মাসের মধ্যে পিএসসি অনুমোদন পাবে বলেও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে অগভীর অংশে ব্লক ১১টি। আর গভীর সমুদ্রে ব্লক ১৫টি। অগভীর ব্লকে পানির গভীরতা ২০০ মিটার পর্যন্ত। এর পর গভীর সমুদ্র ব্লক। বিদেশি কম্পানিকে ব্লক ইজারা দেওয়ার পর তারা সেখানে গ্যাস আবিষ্কার করে।

কিন্তু গ্যাসের মূল্য তাদের কম দিয়েছে বাংলাদেশ- এই অজুহাতে তারা বাংলাদেশ ছেড়েছে। অথচ এসব গ্যাস উত্তোলন করা গেলে বিদেশ থেকে অতিরিক্ত দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করার দরকার হতো না। এখন টিকে আছে শুধু ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি বিদেশ লিমিটেড (ওভিএল)। প্রতিষ্ঠানটি অগভীর সমুদ্রের ৪ নম্বর ব্লকে কাঞ্চন নামের এলাকায় অনুসন্ধান কূপ খনন করে গ্যাস পায়নি। পরে আরেকটি কূপ খননের কাজ শুরু করেছে তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক তেল-গ্যাস কম্পানি এক্সনমোবিল বাংলাদেশের সমুদ্রের ব্লকগুলোতে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি এমন একটি প্রস্তাব পেট্রোবাংলায় পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি এখনো প্রাথমিক আলোচনায় রয়েছে, নীতিগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘পিএসসিতে গ্যাসের যে দাম ধরা হয়েছে, তা অনেক কম। যার কারণে বিদেশি কম্পানিগুলো গ্যাস না উত্তোলন করে চলে যায়। বিদেশি কম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে পিএসসি সংশোধন করা হয়েছে। নতুন পিএসসিতে গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। সংশোধিত পিএসসি এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, আগামী দুই মাসের মধ্যে পিএসসি অনুমোদন দেবেন প্রধানমন্ত্রী।’

ভারত ও মিয়ানমার তাদের সমুদ্রসীমায় বিপুল গ্যাস সম্পদের খোঁজ পেয়েছে জানিয়ে ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, ‘মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে গ্যাস তুলছে এবং তা রপ্তানি করছে চীনে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো জরিপ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারেনি। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকলে বড় বিদেশি কম্পানি সমুদ্রে অনুসন্ধানে আগ্রহী হয় না। এ জন্য মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। এই জরিপের তথ্যই কম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে অনুসন্ধানে অংশ নিতে।’

পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) প্রকৌশলী মো. শাহীনুর ইসলাম বলেন, ‘সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ান তেল-গ্যাস কম্পানি সান্তোস চলে গেছে। কম্পানিটি আমাদের কাছে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করে বলেছিল, চুক্তির দাম অনুযায়ী গ্যাস উত্তোলন করলে তাদের লাভ থাকবে না। কিন্তু চুক্তির বাইরে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ না থাকায় গ্যাসের দাম বাড়ানো যায়নি। এখন বিদেশি কম্পানিকে টানতে পিএসসিতে নানা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।’

শুরু হয়েছে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বহুমাত্রিক জরিপ মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ শুরু করেছে আন্তর্জাতিক কম্পানি টিজিএস-স্লামবার্জার। নিজ উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠানটি সমুদ্রে সার্ভের কাজ শুরু করেছে। সার্ভে পরিচালনার যাবতীয় ব্যয় কম্পানিটি বহন করবে। কোনো কম্পানি যখন বাংলাদেশের সমুদ্রভাগে তেল-গ্যাস উত্তোলন করতে চাইবে, তখন তারা এ সার্ভের তথ্য বা জরিপের তথ্য কিনে নেবে।

মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ কবে নাগাদ শেষ হতে পারে— এই বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক শাহীনুর ইসলাম বলেন, ‘মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ আগামী মে মাসে শেষ করে আমাদের ডাটা দেবে টিজিএস-স্লামবার্জার। সেই ডাটার ভিত্তিতে আমরা বুঝতে পারব সমুদ্রে কী পরিমাণ গ্যাস-তেলের উৎস রয়েছে। এই সার্ভের ডাটা দেখে অনেক বিদেশি কম্পানি সমুদ্রে কূপ খননের আগ্রহ দেখাবে।’

গ্যাস তুলতে না পারলে সুবিধা নেবে মিয়ানমার ও ভারত

বাংলাদেশ দ্রুত সমুদ্রভাগ থেকে গ্যাস তুলতে না পারলে তার সুবিধা নেবে মিয়ানমার ও ভারত। ২০১৬ সালে মিয়ানমারে থালিন-১ নামক ব্লকে গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দেয় দেশটি, সেখানে সাড়ে চার ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আছে। এখান থেকে গ্যাস তোলা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের সুয়ে, সুয়ে ফিয়াও, মায়ে ও মাহার গ্যাসক্ষেত্র বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলের একদম গা ঘেঁষে। এসব গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস তুলছে মিয়ানমার। গ্যাস রপ্তানিও করছে দেশটি।

অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশের কৃষ্ণ-গোদাভারী বেসিন এলাকায় প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে বলে আশা করছে ভারত। দেশটির প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি, গুজরাট এস্টেট পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বেসরকারি শিল্প গ্রুপ রিলায়েন্স এই এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে কাজ করছে। রিলায়েন্স এই বেসিনের কেজি ডি-৬ ব্লকে তিনটি গ্যাসকূপ খনন করছে। চলতি বছরের মধ্যে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে চায় ভারত।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গ্যাস মজুদের বিষয়ে নরওয়ের বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কম্পানি স্টেট অয়েল (বর্তমানে ইকুইনর) গবেষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্রগর্ভ (পিএসসি ব্লক এসএস-১১) থেকে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব। মিয়ানমারের গ্যাস রিজার্ভারগুলোর মতো আমাদেরগুলো খুবই সম্ভাবনাময়। এখানে প্রসপেকটিভ রিসোর্স ক্যাটাগরিতে সাত টিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে।’

সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের কারণে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের বাধার মুখে ছিল বাংলাদেশ। বিষয়টি আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে ২০১২ সালের ১৪ মার্চে। ভারতের সঙ্গে বিরোধও শেষ হয়েছে ২০১৪ সালের জুলাইয়ে। আদালতের রায়ে প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়, যাকে ‘সমুদ্র বিজয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

সূত্র: কালেরকণ্ঠ

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , , ,

oceantimesbd.com