সমুদ্রসম্পদ

সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের অংশ হিসেবে বিশ্ব সমুদ্র দিবস উপলক্ষে গত ৮ জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেইফ, নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট যৌথভাবে কক্সবাজারে ‘বঙ্গবন্ধু বে অব বেঙ্গল ফেস্টিভ্যাল-২০২২’ এর আয়োজন করে। ‘বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি, বঙ্গোপসাগরে সুনীল অর্থনীতির সৃষ্টি’ স্লোগান সামনে রেখে আয়োজিত ওই উৎসবে উপস্থিত থেকে আমার বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়। সেই আলোকেই আমার এ নিবন্ধ।

আমরা জানি, ২০১২ সালে রিও ডি জেনিরো, ব্রাজিলে টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক জাতিসংঘ সম্মেলনে প্রথম ‘ব্লু ইকোনমি’ উত্থাপিত হয়। সাগরের জলরাশি এবং এর তলদেশের বিশাল সম্পদকে কাজে লাগানোই হচ্ছে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি। কেবল সমুদ্রের নিচের অর্থনৈতিক কার্যক্রম নয়; সমুদ্রনির্ভর যে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই সুনীল অর্থনীতির আওতায় পড়ে। ব্লু ইকোনমির বিশেষ অনুষঙ্গ মৎস্য, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ আহরণ।

বঙ্গোপসাগরের সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে সমুদ্রে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে সমুদ্র বিজয় অভিযাত্রার সূচনা করেন। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় তিনি বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন, যা গেজেট হিসেবে প্রকাশ পায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে।

পরবর্তী সময়ে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ১৯৭৪ সালের আইনটি প্রয়োজনীয় সংশোধনপূর্বক ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০২১’ প্রণয়ন করে। ওই বিলে ‘ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি (আনক্লোস, ১৯৮২)’ ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন এবং সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত মামলার রায়ের যথাযথ প্রতিফলন ঘটানো হয়।

বস্তুত ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক সমুদ্রবিষয়ক আইন পাস হওয়ার পরপরই মিয়ানমারের সঙ্গে সেন্টমার্টিনে ১২ মাইল ‘টেরিটোরিয়াল সি’ ঠিক করে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭৪ সালে প্রণীত আইনটিই আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এর প্রতিফলন দেখা যায় ৮ বছর পর ১৯৮২ সাল থেকে, যা চূড়ান্তভাবে জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশন হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে।

পরবর্তীকালে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আনক্লোস আইনটি অনুসমর্থন করে। ফলে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে ৩৫০ মাইলব্যাপী মহীসোপানের দাবি জাতিসংঘে উত্থাপনের দায় সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার ২০০৯ সালে দীর্ঘ ৩৮ বছর ঝুলে থাকা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক প্রজ্ঞায় ২০১২ ও ‘১৪ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের সমপরিমাণ টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ অধিকার ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, যা মূল ভূখণ্ডের ৮০ দশমিক ৫১ শতাংশ।

বিশ্বব্যাপী সমুদ্র ঘিরে তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। বিশ্বের মানুষের ১৫ শতাংশ আমিষের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, প্রাণী ও উদ্ভিদ। সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে পৃথিবীর ৩০ শতাংশ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে সমুদ্রনির্ভর ওষুধশিল্পও গড়ে তোলা সম্ভব।

ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাবার জোগান দিতে বিশ্ববাসীর সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে। তাই বিগত বছরগুলোতে সব আন্তর্জাতিক সম্মেলন যেমন- অর্থনৈতিক সহায়তা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি), জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি), বিশ্বব্যাংক, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) প্রভৃতিতে সুনীল অর্থনীতি আলোচনার কেন্দ্রে ছিল।

সমুদ্র অর্থনীতি জোরদারে বাংলাদেশও বিভিন্ন ধরনের সমন্বিত নীতি, পরিকল্পনাসহ সেমিনার, ফেস্টিভ্যাল ইত্যাদি আয়োজন করে চলেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর সমুদ্র সম্পদ আহরণে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কর্মপন্থা, পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে ‘ব্লু ইকোনমি সেল’ গঠন করে। এ ছাড়া সমুদ্রসম্পদ সুরক্ষায় সরকার ২০১৯ সালে মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট করেছে। এরই মধ্যে সরকার সামুদ্রিক অর্থনীতির বিকাশে ২৬টি সম্ভাবনাময় কার্যক্রম চিহ্নিত করেছে।

সুনীল অর্থনীতি খাতের উন্নয়নকে বেগবান করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক, বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট বিশ্নেষণপূর্বক নিল্ফেম্নাক্ত সুনির্দিষ্ট ৯টি খাত চিহ্নিত করে সেসব খাতের বিকাশ ও বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে। খাতগুলো হলো- ১. সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা; ২. সামুদ্রিক মৎস্য চাষ উন্নয়ন; ৩.বাণিজ্যিক নৌপরিবহনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন; ৪. সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের বিকাশ সাধন; ৫. অফশোর জ্বালানি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সুনীল বায়োটেকনোলজি গবেষণা ও উন্নয়ন; ৬. স্থিতিশীল জীবিকার জন্য ম্যানগ্রোভের বাস্তুসংস্থানগত বিভিন্ন সেবা নিশ্চিতকরণ; ৭. জাহাজ নির্মাণ ও রিসাইক্লিং শিল্প সম্প্রসারণ; ৮. সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ; ৯. মেরিন স্পেশাল প্ল্যানিং বাস্তবায়ন।

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্রসম্পদের অবদান মাত্র ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অথবা ৬ শতাংশ। দেশের স্থলভাগের প্রায় সমপরিমাণ সমুদ্রসীমা এখন মূল্যবান সম্পদের ভান্ডার। এসব সম্পদ ও সম্ভাবনার যথাযথ ব্যবহারে সামুদ্রিক অর্থনীতি বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। সরকার ইতোমধ্যে সুনীল অর্থনীতির সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার ওপর বিশেষ নজর দিচ্ছে। সমুদ্র গবেষণা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে সরকার বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং একটি মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছে। এ ছাড়া হাতে নেওয়া হয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ।

সুনীল অর্থনীতির সুদূরপ্রসারী অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত ও সঠিক পরিসংখ্যান করে বিনিয়োগকারীদের এ খাতে কীভাবে আকৃষ্ট এবং এ খাতের উন্নয়ন করা যায়, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভরতা ও দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ সম্পর্কে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় যেসব অনাবিস্কৃত সমুদ্রসম্পদ আছে, সেগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিবেশবান্ধব সংগ্রহ এবং টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাসসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ উত্তোলন, মৎস্যসম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। একই সঙ্গে সুনীল অর্থনীতিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও পরামর্শ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

এ ছাড়া অপার সম্ভাবনাময় এই খাতকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে সমুদ্রের তলদেশে কী কী সম্পদ রয়েছে, সেগুলো আহরণ করতে হলে কোন ধরনের প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ জনবল প্রয়োজন, তা পরিকল্পনামাফিক নির্ধারণ করে সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমায় অধিকার, শান্তি-শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে আন্তর্জাতিক সীমা লঙ্ঘন আইনের ধারাগুলোর সর্বোচ্চ বাস্তবায়ন করতে হবে।

দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমুদ্রসম্পদের অপরিসীম ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে সুনীল অর্থনীতি। এর ফলে বাড়বে রাজস্ব; জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে ত্বরান্বিত। সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর মাধ্যমে ‘ভিশন-২০৪১’ তথা উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে পথরেখা প্রণয়ন করেছেন, তা অর্জন সম্ভব।

সাজ্জাদুল হাসান: চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স; সাবেক সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

সূত্র: দৈনিক সমকাল

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , ,

oceantimesbd.com