পায়রা ছেড়ে মোংলায় আগ্রহী চীন ও ভারত

গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মাধ্যমে পায়রাকে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের বৃহৎ লজিস্টিক হাবে রূপ দেয়ার লক্ষ্য ছিল সরকারের। কিন্তু ভৌগোলিক ও প্রতিবেশগত চ্যালেঞ্জের কারণে পায়রাকে ঘিরে নেয়া পরিকল্পনাগুলো এখন পর্যন্ত সেভাবে ফলদায়ী হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। স্থান বদলে সাধারণ সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলেও এখনো জাহাজ ভেড়ানোর জায়গা হিসেবে খুব একটা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি পায়রা বন্দর।

বন্দর হিসেবে পায়রার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকায় বাণিজ্যিক ও ভূরাজনৈতিক উপযোগিতা বেড়েছে মোংলা বন্দরের। আঞ্চলিক ভূরাজনীতির দুই প্রতিযোগী দেশ ভারত ও চীন—উভয়ই এখন বন্দরটি নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বন্দরটি ব্যবহারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে দুই দেশই। এগিয়ে আসছে মোংলা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ নিয়ে। মোংলা বন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে এরই মধ্যে ভারতের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। আনুষ্ঠানিক চুক্তি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে চীনের সঙ্গেও। প্রতিযোগিতা থাকলেও এখন পর্যন্ত বন্দরে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে দুই দেশের কোনোটিই একে অন্যের প্রতি বৈরী মনোভাব প্রদর্শন করেনি।

বন্দরটির আধুনিকায়নে প্রথম দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায় বছর সাতেক আগে। ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়। ওই বছরই মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ চীনা ন্যাশনাল কমপ্লিট ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকটি পরিবর্তন করে সাধারণ চুক্তিতে নবায়ন করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে ওই চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এরপর ২০২১ সালের জুলাইয়ে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুনভাবে চুক্তি করে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। চুক্তি হলেও তখনো দোদুল্যমান ছিল বিষয়টি।

এর মধ্যেই কয়েক মাস আগে ভারতের সঙ্গে একটি বিনিয়োগ চুক্তিতে সই হয়। এর কিছুদিনের মধ্যে মোংলা বন্দর নিয়ে নতুন করে আগ্রহ জানায় চীন। চলতি বছরের শুরুর দিকে চীনের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করা হয়, বন্দরটির আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করতে চায় বেইজিং।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ইজিস ইন্ডিয়া কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের মধ্যে গত ২৬ ডিসেম্বর আপগ্রেডেশন অব মোংলা পোর্ট প্রকল্পের চুক্তি সই হয়। এ উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইজিস ইন্ডিয়া দেবে ৪ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ সরকারকে ব্যয় করতে হবে ১ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। ভারতের তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি বন্দরের সংরক্ষিত এলাকা ও বন্দর ভবন সম্প্রসারণ এবং আটটি জলযান কেনার বিষয়টিও প্রকল্পের আওতায় রয়েছে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা বলেন, ‘এ প্রকল্পের আওতায় ১২টি কম্পোনেন্ট থাকবে। এগুলো হচ্ছে বন্দর জেটিতে ১ ও ২ নম্বর কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, কনটেইনার হ্যান্ডলিং ইয়ার্ড, কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড, ইয়ার্ড শেড নির্মাণ এবং নিরাপত্তা দেয়াল অটোমেশন ও অবকাঠামোসহ সংরক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণ।

এছাড়া মেরিন ওয়ার্কশপ কমপ্লেক্স নির্মাণ, সার্ভিস ভ্যাসেল জেটি শেড ও অফিস নির্মাণ, বন্দর ভবন সম্প্রসারণ, পোর্ট রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্স কমিউনিটি সুবিধা বাড়ানো, ইকুইপমেন্ট ইয়ার্ড, ইকুইপমেন্ট শেড, সিগন্যাল রেড ক্রসিং এবং দিগরাজ রেল ক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণসহ আরো বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এ প্রকল্পে রাখা হয়েছে।’

‘অ্যাক্ট ইস্ট’ (পূর্বদিকে সক্রিয়তা বাড়ানো) নীতিমালার আওতায় ২০১৪ সাল থেকেই নিজ সীমান্তের পূর্বদিকে সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে ভারত। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা নিয়ে গঠিত অঞ্চলটি এখন দেশটির আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি-সংক্রান্ত পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে।

যদিও এক্ষেত্রে বড় সমস্যা দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর কোনোটির সঙ্গেই সমুদ্রের কোনো সংযোগ নেই। এসব রাজ্যের সবচেয়ে কাছাকাছি বন্দর কলকাতায়। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো থেকে দীর্ঘদিন সেখানে পণ্য পরিবহনের একমাত্র উপায় ছিল শিলিগুড়ি করিডোর, যা চিকেন’স নেক নামেও পরিচিত। দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় রাজ্যগুলোর পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ হতো অনেক বেশি। বিষয়টি অঞ্চলটির সার্বিক উন্নয়নেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তিগুলোর পর এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছে।

মোংলায় বিনিয়োগসংক্রান্ত চুক্তির বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোংলা বন্দর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য প্রসারের পাশাপাশি কানেক্টিভিটি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। কলকাতা বন্দরের বিকল্প হিসেবে চট্টগ্রাম বা মোংলার ব্যবহারের সুযোগ হয়ে উঠতে পারে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আট রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। এছাড়া ট্রানজিট সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল-ভুটানে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের বন্দর দুটির ব্যবহার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই লাভবান করতে পারে।

মোংলার উন্নয়নে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির কিছুদিনের মধ্যেই চীনও বন্দরটি নিয়ে নতুন করে আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে। মোংলা বন্দরের আধুনিকায়ন ও প্রশস্তকরণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশটির কাছে আগেই ৪০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ আহ্বান করেছিল বাংলাদেশ। ওই প্রস্তাবে এরই মধ্যে সাড়া দিয়েছে চীন। উন্নয়ন প্রকল্পের সব ধরনের সম্ভাব্যতা দ্রুত যাচাই-বাছাইয়ের পর গত ৪ জানুয়ারি এ নিয়ে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে প্রকল্পটিকে উল্লেখ করা হয় ‘বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে।

ভারত ও চীন উভয় দেশই এখন দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বন্দর অবকাঠামোয় গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। বহুল আলোচিত বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (বিসিআইএম) পরিকল্পনার বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে বন্দর অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোংলা বন্দরটির ভৌগোলিক সুবিধা ও বাণিজ্যিক মুনাফাযোগ্যতার বিষয়টি চিন্তা করেই চীন ও ভারত—উভয় দেশ এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তবে এখনো সক্ষমতাসহ অনেক দিকেই চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় বেশ পিছিয়ে মোংলা বন্দর। যান চলাচল সুবিধা এবং কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতায় অনেক দুর্বলতা রয়েছে বন্দরটি।

বৈশ্বিক জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুদের প্রায় ৪০ শতাংশই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত। হাইড্রোকার্বনের প্রাচুর্য রয়েছে বঙ্গোপসাগরেও। বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক ভূরাজনীতিতেও এখন চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের গুরুত্ব আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আবার এর সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টিও মোংলা নিয়ে চীন-ভারতের আগ্রহের পেছনে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের।

চীনে এখন তৈরি পোশাক শিল্পে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। দেশটির অনেক উদ্যোক্তা এখন তাদের তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসা বাংলাদেশে স্থানান্তরের কথা ভাবছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। আবার বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রও এখন তৈরি পোশাকে চীনের বিকল্প উৎস খুঁজছে। এছাড়া শ্রমব্যয়, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পাওয়া রফতানি সুবিধা ও মার্কিন বাজারে পাওয়া সুবিধার মতো বিষয়গুলোর দিক থেকেও বাংলাদেশ বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, চীনের পরিবর্তে বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন ও এখান থেকে রফতানি বেশি সুবিধাজনক হবে।

এ বিষয়টিও বাংলাদেশের বন্দর অবকাঠামো প্রকল্পগুলোয় চীনের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে বলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এসব পর্যবেক্ষণের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে তৈরি পণ্য রফতানি পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের পুরোটাই হয় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে। এ কারণে দুটি বন্দর নিয়েই ভারত ও চীন প্রায় সমান আগ্রহী।

বন্দরসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, মোংলা বন্দরের উন্নয়নকাজে ভারতের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের পর অন্যান্য প্রক্রিয়া এখন চলমান রয়েছে। এরপর কাজ শুরু হবে। আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হতে আরো প্রায় ছয়-সাত মাস সময় লাগবে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে মোংলা বন্দরের আনুষ্ঠানিক চুক্তিও এখন প্রক্রিয়াধীন।

সরকারের খাতসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিই এখানকার বন্দরে বিনিয়োগ করতে বিদেশীদের আকৃষ্ট করছে। নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন অগ্রগতি এখন সারা পৃথিবীতেই আলোচিত বিষয়। এ আলোচনার কারণেই বিনিয়োগকারীরা আসছে।

বাংলাদেশের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলেই বিনিয়োগকারীরা আসছে। এখন ভারত বিনিয়োগ করছে। তারা আগে কখনো এখানে বিনিয়োগ করেনি, এখন করছে। চীন আগে কখনো বিনিয়োগ করেনি। তারাও এখন করছে। কারণ সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান সরকার সে প্লাটফর্ম তৈরি করতে পেরেছে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা তৈরি হয়েছে। নেতৃত্বও এখানে একটা বড় বিষয়।’

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , ,

oceantimesbd.com