বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং শিপিং শিল্প: একটি আসন্ন সংকট

বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই হয় সমুদ্র পথে। বৈশ্বিক উষ্ণতার দরুন সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রে হারিকেন, ভারী বৃষ্টিপাত এবং তুষার ঝড়ের পরিমাণ বাড়ছে। যা এই শিপিং শিল্পকে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে গভীর সমুদ্রের নৌযান এবং তীরবর্তী বন্দরগুলো বিপদজনক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যাশিত পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২১০০ সালের মধ্যে বন্দর অবকাঠামোর অতিরিক্ত বার্ষিক ক্ষতি প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছতে পারে, পাশাপাশি প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে এই শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়নকে ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও কিছু ব্যবসায়ী একে আশীর্বাদ ভাবছেন। কারন এর ফলে আর্কটিক অঞ্চলে চলাচল আরো সহজ হবে। ফলে সমুদ্রে জান চলাচলে জট দূর হবে।

কোথাও কোথাও সমুদ্রের উচ্চতা বাড়লেও জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন সৃষ্ট খরায় পানামা সহ বিভিন্ন জলরাশি শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে ঐসব স্থানে জাহাজের চলাচলের পথ সংকীর্ণ ও গতি ধীর হচ্ছে। উষ্ণায়নের ফলে যে শুধু এই শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা কিন্তু না, এর পাশাপাশি বৈশ্বিক বাণিজ্যকেও এর ক্ষতি পোহাতে হচ্ছে। সুতরাং এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অর্থ পুরো বিশ্ববাণিজ্য পরিবহন হুমকিতে পরা। যা শিপিং শিল্প উদ্যোক্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ তৈরি করছে।
এই শিল্প যে শুধু নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এমন না বরং বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য এর দায়ভার অনেক। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমনে অন্যতম কয়েকটি নিয়ামক শিল্পের মধ্যে জাহাজ শিল্প অন্যতম। বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৩ শতাংশ এই খাত থেকে আসে, ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড(CO2 ) নির্গমনে এর ভূমিকা ব্যাপক।

এছাড়াও জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যাবহারের ফলে কালো ধোয়ার সাথে ছাই নির্গমনের ফলে ব্যাপক ভাবে বায়ু দুষিত করছে এ শিল্প। বিভিন্ন সময় কন্টেইনার দুর্ঘটনায় তেল, বিষাক্ত কেমিকেল সহ নানা পদার্থ সমুদ্রের পানিতে মিশে যায়, যা সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানকে হুমকিতে ফেলছে। এছাড়াও নৌযানগুলোর উৎপন্ন শব্দের ফলে বাস্তু সংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ন্যাচারাল ইকোলজি এন্ড ইভোলিউশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে ১৯৬০ সালের পর প্রতি দশ বছর অন্তর শব্দ দূষণের হার দ্বিগুণ হচ্ছে।

গ্রিনহাউজের ফলে উৎপন্ন তাপের প্রায় ৯০ শতাংশ এবং জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইডের ২৬ শতাংশ শোষণ করেছে সমুদ্র। ফলে ভূমি এবং বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি কিছুটা হ্রাস হচ্ছে, তবে জীবাশ্ম জ্বালানীর অবাধ ব্যাবহারের ফলে সমুদ্রের এই ক্ষমতা দিনকে দিন কমতে শুরু করছে। ফলস্বরূপ, সমুদ্র কেবল উষ্ণ হচ্ছে না বরং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং অক্সিজেন ধারণ ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবহন প্রায় পুরোপুরি শিপিং শিল্পের উপর নির্ভরশীল, সুতরাং বৈশ্বিক বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং একই সাথে পরিবেশ সুরক্ষায় ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) শিপিংয়ের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে এলএনজি বা হাইড্রোজেনের মতো ক্লিনার জ্বালানি ব্যবহারে উদ্ভুদ্ব করছে। তারা কম-কার্বন প্রপালশন প্রযুক্তির জন্য গবেষণা এবং উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি পরিবেশ বান্ধব জাহাজ চালু করতে যাচ্ছে শিপিং কোম্পানি “মারস্ক”। প্রতিষ্ঠানটি তাদের তৈরি জাহাজে গ্রীন মিথানল ব্যবহার করবে। যা ডিজেল ভিত্তিক জাহাজের তুলনায় ১০০ টন কম কার্বন নিঃসরণ করবে।

পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আর্কটিক অঞ্চলে উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে যেন ওই অঞ্চলের বরফ গলনের হার হ্রাস করা যায়। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (IMO) ১০০ টি প্রতিনিধি দেশে জুলাই মাসে, লন্ডনে একটি বৈঠকে বিশ্বের ক্রুজ লাইনার, কন্টেইনার জাহাজ এবং বাল্ক কার্গো বাহক দ্বারা উত্পাদিত তাপ-ট্র্যাপিং গ্যাসের পরিমাণ কমানোর জন্য একমত পোষণ করেন। এই নতুন পরিকল্পনায় দেশগুলি ২০৫০ সালের মধ্যে বা তার কাছাকাছি সময়ে শিপিং শিল্পকে ডিকার্বনাইজ করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে, যা একই সময়ের ৫০ শতাংশ গ্রীনহাউস গ্যাস (GHG) নির্গমন কমানোর পূর্ববর্তী প্রতিশ্রুতি থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। IMO মহাসচিব কিট্যাক লিম বলেছেন, “এটি শেষ লক্ষ্য নয়, এটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি সূচনা মাত্র, যা আমাদের সামনের বছর এবং দশকগুলিতে আরও তীব্র করতে হবে।”

জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, চরম আবহাওয়ার জনিত দুর্ঘটনা মোকাবেলা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং জলবায়ু-সম্পর্কিত দুর্যোগ প্রতিরোধ করার জন্য বন্দর অবকাঠামোকে উন্নত ও শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়াও পরিবেশ বান্ধব জাহাজ উৎপাদন এবং এর পরিবেশ বান্ধব জ্বালানির যথেষ্ট সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এই মুহুর্তেই পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে, নয়তো ভবিষ্যতে অনেক বড় মূল্য চুকাতে হবে।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , ,

oceantimesbd.com