হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য, নোনাপানির প্রভাবে মরে যাচ্ছে গাছপালা

কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা—এ তিনটি নদ-নদীর ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ঘেরা খুলনার কয়রা উপজেলা। বেড়িবাঁধের ভেতরে হাজার হাজার বিঘা কৃষিজমি। এসব কৃষিজমিতে বেড়িবাঁধ কেটে কিংবা ছিদ্র করে নদীর নোনাপানি ঢুকিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েক হাজার চিংড়িঘের। আর এই চিংড়িঘের গড়ে তুলেছেন জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা। এতে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রায়ই উচ্চ জোয়ারে পানি ঢুকে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নোনাপানির প্রভাবে গাছপালা মরে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।

কয়রা উপজেলার মঠবাড়িয়া এলাকার সাধারণ মানুষ চিংড়িঘেরের ব্যবসা বন্ধ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, মঠবাড়িয়া এলাকার ১৫ জন ঘেরমালিকের কারণে তিন শ একর জমিতে ধান চাষ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া বাগালী ইউনিয়নের হোগলা এলাকার লবণপানির ঘের বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন এলাকাবাসী।

কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা বাঁধ কেটে চিংড়িঘেরে লবণপানি ঢোকাচ্ছেন।

কয়রা উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলায় মোট কৃষিজমির পরিমাণ ১৭ হাজার ২৭৪ হেক্টর। এর মধ্যে ৬ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে অপরিকল্পিতভাবে লবণাক্ত পানি ঢুকিয়ে চিংড়ির চাষ হয়। গত বছর চিংড়ি চাষের কারণে লবণাক্ত পানির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন কয়রার লোকজন। জোট বেঁধে লবণপানির চিংড়িঘেরের বিরুদ্ধে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা। জনসাধারণের দাবির মুখে সে সময় উপজেলা পরিষদের মাসিক সাধারণ সভায় লবণপানির ঘের বন্ধ করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা একমত হন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২০২৩ সাল থেকে উপজেলার কোথাও নদী থেকে লবণপানি লোকালয়ে প্রবেশ করিয়ে ঘের করা যাবে না।

২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি উপজেলা পরিষদের একটি সভার রেজল্যুশনে উল্লেখ রয়েছে, কয়রার ঘের ব্যবসায়ীরা বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থানের অবৈধ পাইপ ঢোকানোর কারণে বিভিন্ন সময়ে বাঁধ ভেঙে লবণপানিতে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। লবণপানির কারণে আবাদি জমি ও সবুজ গাছপালার ক্ষতি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ২০২৩ সাল থেকে নোনাপানির চিংড়ি চাষ নিষিদ্ধ এবং অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তবে সেই রেজল্যুশনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা পরিষদের কাছে মদিনাবাদ লঞ্চঘাটসংলগ্ন এলাকায় নোনাপানির চিংড়ি চাষ করছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া নদীভাঙনের ঝুঁকিপূর্ণ দশহালিয়া এলাকায় বড় আয়তনের চিংড়িঘেরটি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহসিন রেজার। কেবল এই দুজন নন। নোনাপানির অবৈধ চিংড়ি চাষে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি বিএনপি নেতারাও রয়েছেন।

এ বিষয়ে কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, লবণপানির ঘের নিয়ে মানুষের মধ্যে মতের ভিন্নতা আছে। এ কারণে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আপাতত নতুন সিদ্ধান্ত ঘেরমালিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। ভবিষ্যতে কয়রার বেড়িবাঁধগুলো মজবুত করার কাজ শুরু হলে এমনিতেই লবণপানি ঢোকানো বন্ধ হয়ে যাবে। আশপাশের জমিতে লবণপানি থাকলে নিজে না চাইলেও বাধ্য হয়ে জমিতে লবণপানি তুলতে হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কয়রার সাধারণ সম্পাদক শেখ মনিরুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালে দক্ষিণাঞ্চল সফরে এসে চিংড়িচাষিদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ঘের করে পয়সা কামাবেন আর পাউবোর বাঁধ কেটে বিপর্যয় ডেকে আনবেন, এটা হতে দেওয়া হবে না। অথচ বারবার সেই বিপর্যয়ই ডেকে আনছেন ঘের ব্যবসায়ীরা।’

স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, প্রভাবশালী ঘেরমালিকেরা জোর করে জমি দখলে নিয়ে বছরের পর বছর মাছ চাষ করছেন। তাঁদের কাছে ছোট ছোট খণ্ডের জমির মালিকেরা অসহায় ও জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি ওই এলাকার মানুষ লবণপানির চিংড়িঘের বন্ধ করার দাবি জানিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে মানববন্ধন করেছেন। এতে কোনো লাভ হয়নি।

উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের বড় চিংড়িঘের করছেন একই ইউনিয়নের বিএনপির সভাপতি রফিকুল ইসলাম। মঠবাড়ি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চিংড়ি চাষ অব্যাহত রেখেছেন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সাইদ বিশ্বাস। এসব ঘেরে নোনাপানি ওঠাতে যথেচ্ছভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেজেএসের (জাগ্রত যুব সংঘ) জরিপে বলা হয়, কয়রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধের প্রায় পাঁচ শ জায়গায় কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। পাইপ বসানোর জন্য বাঁধের কাটা স্থানগুলো খুবই দুর্বল হয়ে পড়ায় সামান্য জোয়ারের চাপেই তা ভেঙে এলাকা প্লাবিত করছে।

এ বিষয়ে মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে মিঠাপানির ব্যবস্থা না থাকায় ধান চাষ সম্ভব নয়। এরপরও মজবুত বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হলে কেউ আর লবণপানি ঢোকাতে পারবেন না। তখন স্বাভাবিকভাবেই ঘের বন্ধ হয়ে যাবে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সাতক্ষীরা-২ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, যাঁরা অবৈধভাবে বেড়িবাঁধ কেটে বা ছিদ্র করে নোনাপানির চিংড়ি চাষ করছেন, তাঁদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাপ্তরিক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

সুত্র: প্রথম আলো

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , ,

oceantimesbd.com