জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মাটির নীচে কার্বন স্টোরেজ

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের গতি কমাতে হলে শুধু কার্বন নির্গমন কমালেই চলবে না, নির্গত কার্বনও বশে আনতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন৷ নরওয়েতে এক প্রকল্পে সিওটু ধরে সমুদ্রের নীচে জমা করার উদ্যোগ চলছে৷

নরওয়ের ফিয়র্ডের আড়ালে জলবায়ু সংকটের এক সম্ভাব্য সমাধানসূত্র লুকিয়ে রয়েছে৷ নর্দার্ন লাইটস প্রকল্প সরকারের অর্থায়নে এক বিশাল কর্মসূচির অংশ৷ এই মুহূর্তে সেখানে শুধু নির্মাণের কাজ চলছে৷ কিন্তু অদূর ভবিষ্যতেই বিশ্বের অন্যতম সেরা কার্বন-ডাই-অক্সাইড ক্যাপচার ও স্টোরেজ প্লান্ট গড়ে উঠবে৷

নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইয়োনাস গার স্ট্যোরে সেই কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও নরওয়েতে আমরা কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের মূল্য বাড়িয়ে দিলে আমার মতে এই উদ্যোগের প্রতি বিশাল আগ্রহ দেখা যাবে৷ গোটা বিশ্বে এমনটা হওয়া দরকার৷ তখন সিওটু পুরোপুরি কমিয়ে আনতে বাণিজ্যিক স্বার্থ দেখা দেবে৷ আমাদের সিওটু নির্গমন কমিয়ে আনতেই হবে, উপরে বায়ুমণ্ডলে পাঠালে চলবে না৷ এখানে আমরা ঠিক সেটাই করছি৷”

এই প্রযুক্তি জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চাবিকাঠি হবে বলে নরওয়ের সরকারের বিশ্বাস৷ জাহাজে করে তরল সিওটু নর্দার্ন লাইটস প্লান্টে নিয়ে যাওয়াই এই আইডিয়ার মূলমন্ত্র৷ সেখান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে সেই তরল সমুদ্রে পাম্প করা হবে এবং পাহাড়ের নীচে সমুদ্রের তলদেশের দুই হাজার ৬০০ মিটার গভীরে ঠেলে দেওয়া হবে৷

সেই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই নরওয়েতে এই প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে৷ বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেবার বদলে অতিরিক্ত সিওটু আবার সমুদ্রের তলদেশে পাম্প করা হচ্ছে৷ অন্যথায় সিওটু কর গুনতে হতো৷ সেই সব অভিজ্ঞতা এবার নর্দার্ন লাইটস প্লান্টে কাজে লাগানো হচ্ছে৷ শেল, টোটাল ও একুইনরের মতো বিশাল পেট্রোলিয়াম ও গ্যাস কোম্পানি নিজেদের ‘নোহাউ’ বা জ্ঞান ভাগ করে নিচ্ছে৷

তথ্য কেন্দ্রের উদ্বোধন গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক মাইলফলক৷ গোটা বিশ্বের অতিথিরা সেখানে আয়ত্ত করা জ্ঞান থেকে শিক্ষা নিতে পারেন৷ কর্মসূচি শুরু হলেই সিওটু নির্গমনের পর সেই গ্যাস তরল করে এমন আধারে রাখা হবে৷

ইয়ারা নামের কোম্পানি সার ও শিল্পক্ষেত্রের রাসায়নিক নিয়ে ব্যবসা করে৷ তা সত্ত্বেও সেই কোম্পানি কেন এমন কার্যকলাপ চালাচ্ছে? এর উত্তর সহজ৷ আসলে পরিবেশগত কারণ ছাড়াও ব্যবসায়িক সুবিধাও রয়েছে৷ কোম্পানির প্লান্ট ম্যানেজার মিশায়েল শ্লাউগ বলেন, ‘‘আমার মতে, ডিকার্বনাইজড পণ্যের বিপুল চাহিদা দেখা যাবে৷ বিশ্বের সব প্রান্তেই কি সেটা সমানভাবে ঘটবে? অবশ্যই নয়৷ কিন্তু ইউরোপের সামনে পথিকৃৎ হবার এবং জ্বালানির ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন কার্যকর করার অনন্য সুযোগ এসেছে৷ আমরা সেই প্রক্রিয়ার অংশ হতে চাই৷”

সেই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে আরও কিছু কাজ করতে হবে৷ ২০২৪ সালে ট্যাংকার জাহাজগুলি ইয়ারা বন্দর থেকে কার্বন পরিবহণ শুরু করবে৷

নরওয়ের ব্যার্গেন শহরে গবেষণা কেন্দ্রে বিজ্ঞানীরা সিওটু স্টোরেজ নিয়ে কাজ করছেন৷ নিরাপত্তার বিষয়ে সমালোচকদের সাবধানবাণী সত্ত্বেও সারাহ গাসডার মতো গবেষকরা দুশ্চিন্তার তেমন কোনো কারণ দেখছেন না৷ গবেষক হিসেবে সারাহ গাসডা বলেন, ‘‘মাটির নীচে অনেক প্রাকৃতিক বাধার কারণে সিওটু উপরে উঠতে পারে না৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিই নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেয় এবং কার্বন গলিয়ে খনিজ পদার্থ সৃষ্টি করে৷ সেই প্রক্রিয়ার জন্য কয়েক দশক, কয়েক শতক সময় লাগে৷ কিন্তু ঘটনা হলো, প্রকৃতি তার কাজ করছে৷ এই সিওটু যাতে আবার বায়ুমণ্ডলে বেরিয়ে না আসে, প্রকৃতিই সেটা নিশ্চিত করবে৷”

বহু দশকের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গবেষকরা কার্বন স্টোরেজের প্রযুক্তিগত বিষয়গুলি সম্পর্কে অবগত হয়েছেন৷ কিন্তু ব্যবসায়িক স্বার্থের বিষয়টি এখনো পূর্ণতা পায় নি৷ বর্তমানে নর্দার্ন লাইটস প্রকল্প সরকারি ভরতুকির উপর নির্ভরশীল৷ তাদের এক চালু কার্বন বাজারের প্রয়োজন৷ নর্দার্ন লাইটসের কর্ণধার ব্যোরে ইয়াকবসেন বলেন, ‘‘সিসিএস সরকারি ভরতুকির উপর নির্ভর করলে কখনো কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ও প্রভাব অর্জন করা সম্ভব হবে না৷ আমাদের শিল্পক্ষেত্রে নির্গত লাখ লাখ টন কার্বন স্টোর করতে হবে এবং সেটা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হতে হবে৷”

সমুদ্রের নীচে কার্বন স্টোরেজ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ার গতি কমাতে অবদান রাখতে পারে৷ তবে সত্যি কোনো প্রভাব রাখতে হলে সেই কাজ দ্রুত করতে হবে৷

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , ,

oceantimesbd.com