জলবায়ুর কশাঘাতে উপকূলে বেড়ে উঠছে পুষ্টিহীন প্রজন্ম

সুন্দরবন লাগোয়া উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা। এই জেলার সমুদ্র উপকূল থেকে অনেকটা উপরে হয়েও জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত একটি উপজেলার নাম দেবহাটা। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসারত এক শিশুকে পাওয়া যায়। যার বয়স ১৩ মাস। কিন্তু ওজন মাত্র ৫ কেজি। তার সবসময় জ্বর-কাশি লেগে থাকতো। সবশেষ এই শিশু দাঁড়াতেও পারতো না। হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক জানান সে অপুষ্টিতে ভুগছিলো।

শিশুটির মা সালমা বেগম একজন কিশোরী। তিনি বলেন, সবসময়ই আমার মেয়ের অসুস্থতা লেগে থাকে। এখন সে দাঁড়াতেও পারে না। চিকিৎসক বলেছেন, সে মায়ের পেট থেকেই অপুষ্টি নিয়ে জন্ম নিয়েছে।

দেখতে রোগা-পাতলা কিশোরী সালমা আরও বলেন, আমি নিজেও খুব দুর্বল। চোখেমুখে আন্ধকার দেখি। ঘুরে পড়ে যাই। ডাক্তার বলেছেন, আমিও পুষ্টিহীন। আমার শরীরে রক্ত কম। রক্ত দিতে হবে।

দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একই সময়ে ভর্তি পাওয়া যায় পুষ্টিহীন আরও এক শিশুকে। হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তির তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, প্রতি মাসে এই হাসপাতালের স্যাম কর্নারে ভর্তি হয় অন্তত ৩ থেকে ৪ জন পুষ্টিহীন শিশু। আর উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে যাচাই করে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে কম পুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা ৪০ শতাংশেরও বেশি পাওয়া যায়। দারিদ্রতা ও মায়ের অসচেতনতার পাশাপাশি বাল্যবিয়েই এর প্রধান কারণ বলে জানান হাসপাতালটির চিকিৎসক ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।

সাতক্ষীরার বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরে দেখা যায়, এখানকার প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়া মায়েদের বেশিরভাগই ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সী। দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নে জেলিয়াপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের রোগীর তথ্য যাচাই করে দেখা যায় এখানে প্রতি মাসে ১ হাজার থেকে ১২শ’রোগী চিকিৎসা নেন। যার ৬০ শতাংশই মা। এসব মায়েদের ৫০ শতাংশের বেশি ১৮ বছরের কম বয়সী।

জেলার বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যান যাচাই করে দেখা যায়, ২০২১ সালে জাতিসংঘ জরুরি শিশু তহবিল-ইউনিসেফের এক জরিপে উঠে এসেছে সাতক্ষীরায় মোট বিয়ের ৭৭.৭ শতাংশই হচ্ছে বাল্যবিয়ে। আর জেলা শিক্ষা অফিস বলছে, শুধু করোনাকালেই এখানে বাল্যবিয়ে হয়েছে ৫৪০ জন স্কুল শিক্ষার্থীর। এই সময়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেছে জেলার ১২ শতাংশ স্কুলগামী কিশোরি। অপরিনত বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসা এসব নারী ও তাদের সন্তানরা নানান স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে বলে জানাচ্ছেন ভুক্তোভোগী নারীরাই।

গিতা রানি নামে এক মা জানান, ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে জন্ম দেওয়া তার ছেলে প্রতিবন্ধী হয়েছে। তিনি বলেন, আমার শিশুটি জন্ম থেকেই খুব দুর্বল ছিল। তার নিউমোনিয়া হয়েছিল। সে দুধ টেনে খেতে পারতো না। সবশেষ একদিন সকালে গোসল করতে গিয়ে দেখি সে নিস্তেজ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি সাতক্ষীরা মেডিকেলে নিলে ডাক্তার বলেছেন পুষ্টিহীনতার কারণে এটা হয়েছে। সেই থেকে সে প্রতিবন্ধী।

কুলসুম আক্তার বলেন, আমার বিয়ে হয়েছে ১৩ বছর বয়সে। এখন আমার তিনটা সন্তান। এদের পালতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। আমার বড় সন্তানটি মেয়ে। আমার বাবা যদিও আমাকে ১৩ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছেন কিন্তু এখন তিনি আমাকে সাবধান করেছেন আমি যেন কোনোভাবেই আমার মেয়েকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে না দেই।

দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সালমার সঙ্গে ছিলেন তার মা-ও। তিনি বলেন ডাক্তার ম্যাডাম বলেছেন, বাল্যবয়সে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ায় এমন হয়েছে। আমার মেয়েকে ক্লাস নাইনে থাকতে বিয়ে দিয়েছিলাম। এ কারণে বাবু বেশি পুষ্টি পায়নি বলে এখন সে পুষ্টিহীন। আমার মেয়েটাও পুষ্টিহীন। আমি অনেক বড় ভুল করেছি।

কিন্তু কেন এত বাল্যবিয়ে? জানতে গিয়ে, চরম দারিদ্রতা, সামাজিক অবক্ষয় ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নারীদের স্বাস্থ্যগত নানান ঝুঁকির কথাই উঠে এসেছে স্থানীয়দের বক্তব্যে।

আকলিমা নামে এক নারী বলেন, আমাদের পানিতে লবনের কারণে খুব অল্প বয়সে মেয়েদের জরায়ু নালিতে ঘা হয়ে যায়। জরায়ু সমস্যার কারণে অনেকে সন্তান ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ কারণে কারো জরায়ু সমস্যা হয়েছে শুনলে তাকে বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। এ ভয়ে বাবা মা যৌবন এলেই বিয়ে দিয়ে দেয়।

দেবহাটা ইউনিয়ন পরিষদ ৪ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার বলেন, প্রতি বছর দুর্যোগের কারণে আমাদের এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। ঝড়-বন্যা আর লবনাক্ততায় ফসল নষ্ট হয়ে ঋণের ওপর ঋণ চলছে। এ অবস্থায় মেয়ে ঘরে বসিয়ে রাখা সবাই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। তাছাড়া এলাকায় অনেক অবক্ষয়। তরুণরা মাদকসেবী হয়ে যাচ্ছে। একারণে মেয়েরা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। তাই মেম্বার-চেয়ারম্যানকে লুকিয়েই বিয়ে দেয়। বেশিরভাগ বিয়ে কোর্টে গিয়ে করে।

৫ নং দেবহাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন বলেন, সামাজিক নানান কুসংস্কার প্রচলন আছে, মেয়েদের শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি আছে। সবাই চিন্তা করে মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখলে যে কোনো সময় কিছু ঘটে গেলে আর বিয়ে দিতে পারবে না। তাই চুরি করে বিয়ে দেয়। আমরা বাধা দিলে বলে আপনারা আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছেন। বেশিরভাগ গরিব পরিবারগুলো এটা করে।

বাল্যবিয়ে কীভাবে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে জানতে চাইলে পুষ্টিবিদ ডা. রুমানা আক্তার বলেন, জন্ম থেকে ১ হাজার দিন একটা শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় তার শারীরিক গ্রোথ, ব্রেন ডেভেলপমেন্টসহ শারীরিক অনেক বৃদ্ধির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়ে যথাযথ পুষ্টি পাওয়া শিশুরা অন্য বাচ্চাদের থেকে মেধা, শক্তি, সুস্থতা সবদিক থেকে এগিয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, বাচ্চা পেটে আসার পর মা এবং সন্তান দুজনেরই বাড়তি পুষ্টির প্রয়োজন হয়। কিন্তু মা যদি পুষ্টিহীন হয় তাহলে সেই মা সন্তানের পুষ্টির জোগান দিতে পারে না। ফলে শিশুর পেট থেকেই পুষ্টিহীন হয়ে বেড়ে উঠে।

মা কম বয়সী হলে সন্তানের ওপর কিভাবে প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত একটি মেয়ের শারীরিক বৃদ্ধি ১৮ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ সময়ে তার নিজেরই অনেক চাহিদা থাকে। এর মধ্যে কোনো মেয়ের পেটে সন্তান এলে শিশুর জন্য যথাযথ পুষ্টি তার শরীর থেকে সরবরাহ হয় না, ফলে মা শিশু উভয়ে পুষ্টিহীন হয়। এছাড়া, রক্তের স্বল্পতাজনিত কারণে সে রক্তচাপ, এনিমিয়া, অসময়ে বাচ্চা প্রসবসহ বিভিন্ন জটিল সমস্যায় পড়ে। এই অবস্থায় নিজের দুর্বলতার কারণে শিশুর যথাযথ যত্ন নিতে পারে না। এতে শিশু আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাবে পুষ্টিহীনতা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়ে দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল লতিফ বলেন, আমাদের এই অঞ্চল ব্যাপক দুর্যোগপ্রবন। বছরে দুএকটা ঝড় এখানে আঘাত করেই। তখন নানান সংকটে শিশুর যত্ন নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে শিশুরা পুষ্টিহীন হয়ে পড়ে।

তিনি আরও বলেন, সাধারণত ঝড় হলে ফসলের ক্ষতি হয়। দুধ-ডিমসহ পুষ্টিকর ফলের সংকট তৈরি হয়। তাছাড়া, উপকূলের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে পুষ্টিকর খাবার কিনেও খাওয়াতে পারে না। এতে পুষ্টিসংকটে পড়ে মা ও শিশু। তাছাড়া, লবনাক্ত পানির কারণে নারীদের নানান সমস্যায় পড়তে হয়।

জরায়ু সমস্যার কারণে এখানকার অনেক নারী সন্তানধারণ ক্ষমতা হারাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ. বি. এম. খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, এখানে অত্যাধিক বাল্যবিয়ের কারণ খুঁজতে গিয়ে নারী পাচার, লবনাক্ত পানিতে নারীদের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা, অত্যাধিক দারিদ্রতা ও সামাজিক অবক্ষয়কে মূল কারণ হিসেবে খুঁজে পেয়েছি। এছাড়া সামাজিক অসচেতনতাবোধও রয়েছে।

উপজেলায় প্রায় ৯০ শতাংশ নারী লবনাক্ত পানির কারণে নানান ইউরিন ইনফেকশনে ভুগছে বলেও জানান তিনি।

পিছিয়ে পড়া জনপদে শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার নিয়ে কাজ করছে শিশু বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনসহ স্থানীয় বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগি সংগঠনের একটি কনসোর্শিয়াম। জলবায়ু পরিবর্তনে পিছিয়ে পড়া উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী ও বরগুনায় রাইট টু গ্রো প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্পও পরিচালনা করছে তারা। এই প্রকল্পটি মূলত শিশুর পুষ্টি নিশ্চিতে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় পর্যায়ে এডভোকেসি করছে। প্রকল্পটির ম্যানেজার ও সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের কর্মকর্তা মো. তাওফীকুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন যে এখানকার অর্থনীতি, খাদ্য উৎপাদন, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিব্যবস্থায় সংকট তৈরি করছে এটা সুস্পষ্ট। এতে এই অঞ্চলের মানুষ সমতলের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। ফলে ব্যহত হয় তাদের পুষ্টিব্যবস্থাও। পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে মূল ধারার সাথে একত্রিত করতে হলে এখানকার জলবায়ুর ক্ষতি পুশাতে বাড়তি বরাদ্দ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নয়লে তারা প্লেন ল্যান্ড থেকে পিছিয়ে পড়বে।

তিনি আরও বলেন, শিশুরা দেশের আগামীর সম্পদ। কিন্তু তারা যদি শিশুকাল থেকে দুর্বল হয়ে গড়ে উঠে তাহলে শেষ পর্যন্ত এর ভার বহন করতে হয় রাষ্ট্রকে। তাই শিশুকালেই এদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা দেওয়া প্রয়োজন। এদের শক্তিশালী করে গড়ে তোলা আমাদের রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। তাই আমরা স্থানীয় সরকার ও জাতীয় পর্যায়ে পিছিয়ে পড়া শিশুদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিতে এডভোকেসি করছি। চেষ্টা করছি সবাইকে সচেতন ও আন্তরিক করে শিশুর যথাযথ বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে।

বিশেষ করে স্বাস্থ্যের বরাদ্দের পাশাপাশি পুষ্টির বরাদ্দ যুক্ত করা দরকার। আমরা এ বিষয়টি সরকারের সঙ্গে এডভোকেসি করছি। শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিতে ইউনিয়ন পরিষদে আলাদা বরাদ্দ দিতে এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , , , ,

oceantimesbd.com