নদীভাঙন

উপকূলে নেই টেকসই বাঁধ, প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করছে শত শত পরিবার

একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বেড়িবাঁধের ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পশ্চিম দুর্গাবাটি গ্রামের গীরেন্দ্র নাথ রপ্তান। এক সময় নিজের বাড়িতেই ফলমূল, শাকসবজি, গোয়ালভরা গরু ও পুকুরভরা মাছ থাকলেও এখন তার ঠাই বেড়িবাধেঁ। বসতঘরের অভাবে একমাত্র ছেলে, ছেলের বউ ও নাতিও ছেড়ে গেছেন তাকে।

গীরেন্দ্র নাথ নয় শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সাতক্ষীরা উপকূলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে বসতভিটা হারিয়ে বাঁধে খুপরি ঘরে কোনোমতে টিকে আছেন দেবী সরদার, সুপদ মন্ডল, তপন মন্ডল, ফনি রপ্তান, অশোক রপ্তান, সুরঞ্জন মন্ডলের পরিবারসহ শত শত পরিবার। প্রকৃতির সঙ্গে চলছে তাদের অসম লড়াই। তারা চান উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ। সরকারি কর্মকর্তারাও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণের কথা শোনাচ্ছেন। কিন্তু হবে কবে টেকসই বেড়িবাঁধ, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য কারও জানা নেই। সরকারি হিসাবে শুধু শ্যামনগর উপজেলাতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা এখন ৪৩ হাজার ১৭৮।

উপকূলবাসী গীরেন্দ্র নাথ বলেন, সাত ভাই-বোনের মধ্যে আমি ছোট। পারিবারিকভাবে আমার পিতার ৩৯ শতক বসতভিটা ও ২৪ বিঘা কৃষি জমি ছিল। পরে আমি চিংড়ি বের করে ৪ বিঘা জমি ক্রয় করতে সক্ষম হয়েছিলাম। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ১৩ শতক বসতভিটা, ৮ বিঘা কৃষি জমি ও আমার ক্রয়কৃত ৪ বিঘাসহ মোট ১২ বিঘা জমি ছিল। নিজের বসতভিটাতেই ফলমূল, শাকসবজি, গরুর দুধ ও পুকুরে মাছ হতো। কিন্তু এখন আমার কিছুই নেই।

তিনি আরও বলেন, ১৯৭০ সালে প্রথমবারের মতো নদীভাঙনের ফলে আমাদের ঘর ভেসে যায়। তখন আমার বয়স ছিল ১৮ বছর। ওই সময় ১৫ শতক বাদে সব ভিটা নদীতে চলে যায়। এর পর ১৯৮১, ২০০৪ ও ২০০৯ সালে চতুর্থ বারের মতো আবারও আমাদের বসতভিটার আংশিক নদীতে চলে যায়। বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও রক্ষা হয়নি। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর গত কয়েক বছরে বুলবুল, ফণী, আম্পান, ইয়াস এবং সর্বশেষ ২০২১ সালের এপ্রিল মাসের উচ্চ জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে আমার অবশিষ্ট সবকিছু পানিতে তলিয়ে যায়। এখন ঠাঁই হয়েছে বাঁধে। তার আক্ষেপ, যদি ঘন ঘন দুর্যোগের কবলে না পড়তাম, ভিটামাটিছাড়া না হতাম, লবণাক্ততা না বাড়ত, জমিতে ঠিকমতো ফসল পেতাম, তা হলে আত্মত্মীয়- স্বজনহারা হয়ে এমন কষ্টের জীবনযাপন করতে হতো না।

দেবী সরদার বলেন, ওয়াপদার বেড়িবাধ ভাঙনের ফলে প্রতিবারই (প্রত্যেক দুর্যোগ) কারও না কারও বাড়িঘর নদীতে চলে যায়। অনেকের ঘরবাড়ি ধসে পড়ে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল যা কিছু থাকে সব শেষ হয়ে যায়। আগে এত ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যেত না। এখন বছরেই কয়েকবার দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়। এতে নিঃস্ব হয়ে অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। তিনি বলেন, জীর্ণশীর্ণ বাধঁও এর জন্য দায়ী। বর্তমানে বিদ্যমান বেড়িবাঁধ সামান্য দুর্যোগেও জনবসতি রক্ষা করতে পারে না।

আরও পড়ুন>>  ঝুঁকিতে ৫ সহস্রাধিক শিশু, নেই কোনো বিদ্যালয়, দেওয়া হয়নি টিকা

স্থানীয় বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম বলেন, আমার ইউনিয়ন থেকে প্রায় এক হাজার আশি পরিবার এই রকম রয়েছে। পরিবারের মতো নদীভাঙনে জমি হারিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় আছে। অনেকে এলাকা ছেড়ে বাইরে গিয়ে বসবাস করছে। কিছু পরিবার এলাকার বেড়িবাঁধের ওপর খুব কষ্ট করে দিন পার করছে।

গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জি এম মাকসুদুল আলম বলেন, দুর্যোগের কারণে ৬শর মতো পরিবার জমিজমা হারিয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। প্রায় ১শর মতো পরিবার এখনো বেড়িবাঁধে বসবাস করছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের আওতাধীন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শাহিনুল ইসলাম জানান, শ্যামনগর উপজেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৪৩ হাজার ১৭৮টি। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে ২২ হাজার পরিবার, আম্পানে ১৫ হাজার ৫১৬ পরিবার, ফণীতে ৩ হাজার ১২০ পরিবার, ইয়াসে ২ হাজার ৫৪২ পরিবার। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ ৩২১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা। এর মধ্যে অনেকের ঘরবাড়ি ধসে যায়। আবার কারও মাছের ঘের ও জমি নদীতে চলে যায়।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আক্তার হোসেন বলেন, শ্যামনগর উপকূলে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তালিকা করে পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে। উপকূলের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য টেকসই বাঁধ করা খুবই প্রয়োজন। পানি উন্নয়ন বোর্ড টেকসই বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: ,

oceantimesbd.com