প্রাকৃতিক দুর্যোগে অরক্ষিত হাতিয়ার চরগাসিয়া, ঝুঁকিতে ১৭ হাজার মানুষ

চারপাশ খোলা, নেই কোনো বেড়িবাঁধ। তৈরি করা হয়নি মাটির কিল্লা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রয় নেওয়ার মত কোন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি। ঝড় জলোচ্ছ্বাসে সম্পূর্ণ ঝুঁকিতে বসবাস করছেন নোয়াখালী হাতিয়া উপজেলার বিচ্ছন্ন দ্বীপ চরগাসিয়ার প্রায় ১৭ হাজার মানুষ।

দীর্ঘ ১০বছর ধরে এ দ্বীপে মানুষজন বসবাস করে আসলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় ব্যপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় এ চরের বাসিন্দারে, ঘটে প্রাণহানীও। এতো কিছুর পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি, এখনও পর্যন্ত নেওয়া হয়নি দ্বীপের মানুষের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা। চলতি মাসের ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’ নিয়ে চরম আতংকে আছেন এ চরের বসিন্দারা।

চরগাসিয়ার প্রবিন বাসিন্ধা মো: কামাল উদ্দিন (৬০) জানান, এখানে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে আশ্রয় নেওয়ার কোন জায়গা নেই। এজন্য তারা বাড়ীতে শুকনো কাঠের আড়ি বেধে রাখেন প্রবল জোয়ারে ভেসে থাকার জন্য। কেউ কেউ খালি কন্টেনিয়ার ক্রয় করে ঘরে রাখেন।

কামাল উদ্দিন আরো বলেন, গত ১০ বছর ধরে এই চরে বসবাস করছেন । বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন জলোচ্ছ্বাসে অনেকের শিশু সন্তান ভেসে গেছে। চরের মধ্যে উঁচু জায়গা না থাকায় সম্প্রতি আঘাত হানা সিত্রাং এ অনেকের গরু ছাগল ভেসে গেছে। সিত্রাং-এ এই চরে ৪-৫ ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। তাতে সবাই সবার বাড়িতে অবস্থান করতে হয়েছে। অনেকে ঘরের চালের উপর অবস্থান করে থাকতে হয়েছে। বাজারে যাওয়া-আসার পথগুলো পানির নিচে তলিয়ে ছিল দুই-তিনদিন পর্যন্ত। চরের মধ্যে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধ ছিল।

চরগাসিয়ার বারআউলিয়া সমাজের বাসিন্ধা দিনমজুর আলাউদ্দিন জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এ জোয়ারের স্রোতে তার ৬ বছর বয়সী শিশু সন্তানটি ভেসে যায়। জোয়ারের স্রোত তীব্র থাকায় নিজের সন্তানকে উদ্ধার করতে পারেননি। দুই ঘণ্টা পরে প্রতিবেশিরা অজ্ঞান অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করে। শুধু জলোচ্ছ্বাসে নয়। অস্বাভাবিক জোয়ারে এই চর প্লাবিত হয়ে যায়। পথঘাট সব ডুবে যায়। অনেক সময় জোয়ারের পানিতে চার পাশ ৩-৪দিন তলিয়ে থাকে।

বারআউলিয়া বাজারের পাশে মসজিদের ইমাম সুমন হুজুর। চরের উত্তর পাশে ইসলামপুর সমাজে বসবাস করেন তিনি। আলাপকালে সুমন হুজুর জানান, গত বছর জোয়ারের পানিতে ডুবে ফারজানা আক্তার নামে তার দুই বছর বয়সী শিশু সন্তানটি মারা যায়। এই ঘটনার দুই-একদিন পর আলী সমাজের মো: রাজুর শিশু সন্তান বিবি মরিয়মের একইভাবে মৃত্যু হয় । সুমন হুজুর আরো জানান চরের চার পাশে বেড়িবাঁধ না থাকায় পূর্ণিমাতেও এই চর ৩-৪ ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। এতে পানিতে ভিজে লোকজনকে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে হয়। ঘরের আঙ্গিনায় পানি চলে আসায় শিশুরা ঘর থেকে বের হলে পড়তে হয় পানিতে ।

বারআউলিয়া বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফখরুল ইসলাম জানান, গত দুই তিন দিন থেকে টেলিভিশনে ঘূর্ণিঝড়ের সংবাদ শুনে মানুষের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। কেউ কেউ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে লোকালয়ে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়ে উঠছে। অনেকে জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় বাড়ির ঘর গাছের সাথে ভালোভাবে বেধে নিচ্ছেন। গত বছর সিত্রাং এ প্রবল জোয়ারের মানুষের মধ্যে যে ভয় সৃষ্টি হয়েছে তা আরো প্রকট আকার ধারেন করেছে।

তিনি আরো জানান, গত ১৫ বছর ধরে এই চরে বসবাস করছেন। গত বছর সিত্রাং এ যে পরিমান জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল তা বিগত দিনে কখনো হয়নি। চরের মধ্যে সবকটি বাড়ী পানিতে তলিয়ে যায়। মানুষজন আশ্রয় নেওয়ার মত কোন জায়গা পায় নি। ঘরের চালের উপর আশ্রয় নিতে হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে মাত্রা আর একটু বেশি হলে ব্যাপক প্রাণহানী হত এই চরে।

প্রায় দুই যুগ আগে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠা এ চরটিতে ২০১৩ সালে জনবসতি শুরু হয়। বর্তমানে ৭টি সমাজে বিভক্ত ৮ হাজার পরিবার এ চরে বসবাস করছেন প্রায় ১৭ হাজার মানুষ। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বার্সের মতো সকল প্রাকৃতিক দূর্যোগের আগেও পরে কোন প্রকার সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই মোকাবেলা করতে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের।

সাগরের বুকে জেগে ওঠা চরটির চার পাশের কোন পাশেই নেই কোন বেড়ি বাঁধ, তাই জলোচ্ছার্স ও বন্যায় সহজে চরটিতে পানি ডুকে পড়ে। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় ১২ বর্গ কিলোমিটারের এ চরটি। বর্তমানে উপজেলার ১ নং হরনী ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডের অংশ হিসাবে এখানে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

হরনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আখতার হোসেন জানান, ঝড় জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় মসজিদের মাইকে সতর্ক করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় দুর্যোগ মহূর্তে কাউকে নিরাপদে আশ্রয় দেওয়া যায় না। চরের চার পাশে বেড়ীবাঁধ না থাকায় সম্পূর্ণ ঝুঁকিতে থাকে তারা। দূর্যোগ মোকাবেলায় এসব চরে বেড়ীবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবি করেন তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: কায়সার খসরু বলেন, ‘নতুন জেগে উঠা এসব চরে মানুষের বসবাস করছেন ঝুঁকি নিয়ে। এসব চরে এখনো অবকাঠামো তৈরি হয়নি। ঝড় জলোচ্ছ্বাসে ঝুঁকিতে থাকেন তারা। ইতিমধ্যে এখানে আশ্রয়কেন্দ্রসহ অবকাঠামো তৈরি করা জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসকসহ সরকারের উর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা চরগাসিয়া পরিদর্শন করেছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব চরকে উন্নয়নের আওতায় আনা হবে।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , ,

oceantimesbd.com