উত্তাল সাগর গিলছে মেরিন ড্রাইভ-ঝাউবন

একদিকে নিম্নচাপ, অন্যদিকে শ্রাবণের ভরা পূর্ণিমা। এ দুয়ের প্রভাবে গত কয়েকদিন ধরে উত্তাল রয়েছে সাগর। স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি কয়েক ফুট উচ্চতায় আছড়ে পড়ছে তীরে। ফলে উপকূলে দেখা দিয়েছে জলোচ্ছ্বাস। এতে তলিয়ে গেছে অনেক নিম্নাঞ্চল।

সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে পর্যটনের অনিন্দ্য সৌন্দর্য মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ অংশে ডজনের অধিক স্পটে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন মেরামতে হাত দেওয়া হলেও পরবর্তী জোয়ারে আবারও ভাঙনের কবলে পড়ছে সড়কের কিনারা।

বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) রাত ও শুক্রবার (৪ আগস্ট) সকালে জোয়ারের বাড়ন্ত পানির তীব্র ঢেউ তলিয়ে নিয়ে গেছে কয়েক কিলোমিটার ঝাউবনের গাছ। দুর্বল হয়ে গেছে মেরিন ড্রাইভ ও সৈকতের ভাঙন রোধে বসানো জিওব্যাগ। এ পরিস্থিতিতে সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্ট থেকে কবিতা চত্বর, লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলী, দরিয়ানগর, হিমছড়ি, পেঁচারদ্বীপ, ইনানী, পাথুয়ার টেক, টেকনাফ সৈকতের তীরে ভাঙন আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখনই ভাঙনরোধে ব্যবস্থা না নিলে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে টেকনাফ ও সমুদ্র উপকূলের সহজ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে জোয়ারের চাপে জেলার বিভিন্ন উপকূল অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে উপকূলের বিপুল সংখ্যক মানুষ। ভেসে গেছে মাছের ঘের।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের কক্সবাজার সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা সমীর রঞ্জন সাহা জানান, বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার দিনের জোয়ারে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে সাগরের পানি। অন্য সময়ের চেয়ে ঢেউ কয়েক ফুট উঁচু হয়ে তীরে আছড়ে পড়ে। সৈকতের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ ঝাউগাছ উপড়ে পড়ে পানিতে তলিয়ে গেছে। বালুভর্তি জিও ব্যাগগুলো দুর্বল হয়ে পড়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে সৈকত তীরের নানা স্থাপনা।

কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে টেকনাফ অংশে ভাঙন ধরেছে। বৃহস্পতিবার সকালের জোয়ারে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের পশ্চিম মুন্ডার ডেইল এলাকার প্রায় অর্ধশত মিটার সড়ক ঢেউয়ের তোড়ে ভেঙে গেছে। এর আগে গত দুদিনের বাড়ন্ত জোয়ারের পানিতে টেকনাফের বাহারছড়া, হাদুরছড়া, দক্ষিণ মুন্ডার ডেইল এলাকায় একাধিক স্পটে মেরিন ড্রাইভ ভাঙনের কবলে পড়ে। এতে পুরো সড়ক তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাগরে ঢেউয়ের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে জিও ব্যাগ টপকে পানি সড়কে উঠেছে। যে কারণে সড়কে ভাঙন ধরেছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুজ্জামান বলেন, সাগরের জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। মেরিন ড্রাইভের কয়েকটি স্পটে ভাঙন ধরেছে। সেনাবাহিনী সেসব ভাঙনে কাজ শুরু করেছে।

এদিকে, পেকুয়া উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। রাজাখালী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের লালজান পাড়া গ্রামে পাউবো নিয়ন্ত্রিত বেড়িবাঁধ জোয়ারের পানির ধাক্কায় ভেঙে যায়। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বহু পরিবার।

পেকুয়া কাটাফাঁড়ি সেতু-করিমদাদ মিয়া চৌধুরী জেটিঘাট সড়কের ধারিয়াখালী অংশে ফাটল ধরেছে। এ অংশটি যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।

রুপাইখালের ধারিয়াখালী অংশের সড়কে দুই চেইন এলাকায় প্রায় ৫০ মিটার এলাকা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। সড়কটি বিলীন হয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকলে তলিয়ে যেতে পারে ধারিয়াখালীসহ কয়েকটি গ্রাম। উজানটিয়া ও মগনামা ইউনিয়নের ১০ হাজার মানুষের পানিবন্দি হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মগনামা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইউনুস চৌধুরী বলেন, জেটিঘাট সড়কটি দুটি ইউনিয়নের যোগাযোগ মাধ্যম। দ্রুত সংস্কার না হলে যেকোনো সময় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠবে।

উজানটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল করিম বলেন, পুরো উজানটিয়া ও মগনামার দক্ষিণ অংশের লোকজন জেটিঘাট সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। দুইবার নিজের পকেটের টাকা দিয়ে সংস্কার করেছি। পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি বহনকারী গাড়ির কারণে সড়কে ফাটল ধরেছে।

রাজাখালী ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম সিকদার বাবুল জানান, বৈরী আবহাওয়ায় বাড়ন্ত পানির তোড়ে রাজাখালীতে পাউবো নিয়ন্ত্রিত বেড়িবাঁধগুলো চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। লালজান এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে ঘরবাড়িতে পানি ঢুকেছে।

কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীর পশ্চিম বেড়িবাঁধে ঢেউয়ের আঘাতে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়ি ও জিওব্যাগ তলিয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে আমন ধানের চাষাবাদ। জিওব্যাগ দিয়ে বাঁধ সংস্কার করায় অল্প জোয়ারেই ভাঙনের কবলে পড়ে বলে জানিয়েছেন মাতারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হায়দার।

মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের এমপি আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, মাতারবাড়ি ও ধলঘাটায় ১৭ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার সুপার ডাইক বেড়িবাঁধের কাজ খুব শিগগির শুরু হবে। উপকূলীয় এলাকাবাসীকে শতভাগ সুরক্ষা দিতে কাজ করছে সরকার।

অন্যদিকে, কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল হালিম সিকদার বলেন, সাগরে বাড়ন্ত পানির তোড়ে ইউনিয়নের নিয়ারাকাটা, কায়সারপাড়া, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের মলমচরসহ আশপাশের বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। পাউবোকে বিষয়টি জানানো হলে ভরা কোটাল (তীব্র জোয়ার) শেষ হলেই দ্রুত মেরামতের আশ্বাস দিয়েছেন তারা।

এদিকে, সতর্কতা সংকেত ও সাগর উত্তাল থাকায় কক্সবাজারে অবস্থান করা পর্যটকদের সমুদ্রস্নান কিংবা পানিতে নামার ক্ষেত্রে সতর্ক করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও সি সেফ লাইফ গার্ড।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার শেহেরীন আলম বলেন, জোয়ারের পানিতে নেতিয়ে যাচ্ছে জিওব্যাগ। যেখানে জিওব্যাগ নেই সেখানকার ঝাউগাছ উপড়ে যাচ্ছে। সবকিছু বিবেচনায় সাগর উত্তালের কারণে পর্যটকদের পানিতে নামতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ জানান, সাগর উত্তাল থাকায় মাছ ধরার ট্রলারগুলো উপকূলের মোহনায় নোঙররত অবস্থায় রয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-বিহার ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানকারী নিম্নচাপটি দুর্বল হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। নিম্নচাপটি দুর্বল হলেও বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর জন্য এখনো শঙ্কা কাটেনি। সে কারণে চারটি সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

সূত্র: জাগোনিউজ২৪.কম

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , , ,

oceantimesbd.com