ওশানটাইমস ডেস্ক : ২৭ এপ্রিল ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ২১:২৮:০২
মাঘী পূর্ণিমার দুই দিন পর, বেলা সোয়া দুইটা হবে। সুন্দরবনের কটকার খালের পূর্ব দিকে দুটি ছোট মাছ ধরা নৌকা দেখে এগোনো। কিছুটা সামনে এগোতে চোখে পড়ে আরও চারটি নৌকা। এরই মধ্যে সরু খালের মুখে একটি নৌকা দেখা গেল। কাছে যেতেই নৌকা নিয়ে সাগরমোহনার দিকে ছুটতে থাকেন কয়েকজন জেলে। কী করছিলেন বা কী মাছ পেলেন- এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চলে গেলেন তারা।
মূলত সুন্দরবনের এ এলাকা অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে মাছসহ সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ করা নিষিদ্ধ। ওই দিন রাতে জোয়ার শুরুর আগে কটকা খাল দিয়ে বনের শেলা নদীর দিকে এগোতেই আবারও কয়েকটি জায়গায় দেখা গেল জেলেদের। অভয়ারণ্য এলাকায় অন্তত নয়টি স্থানে দেখা গেল চরপাতাজাল পাততে।
পূর্ণিমায় মাছ বেশি পাওয়া যায় জানিয়ে বনের ভেতরের নদী ও খালে আড়াআড়ি জাল ফেলে মাছ ধরা হয় বলে জানালেন তিনটি পর্যটক বোটের তিনজন মাস্টার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, পরিচয় প্রকাশিত হলে তাঁরা সুন্দরবনে কাজ হারাবেন, তাঁদের কোম্পানিও বিপদে পড়বে। তবে বন বিভাগকে টাকা দিলে অবাধে অভয়ারণ্যেই মাছ ধরা যায়।
অভয়ারণ্য এলাকায় মাছ শিকারের পাশাপাশি গোপনে পাখি শিকারও হয় বলে অভিযোগ আছে। সুন্দরবন রক্ষায় বন বিভাগ কী করছে, সে প্রশ্নও করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের সুপতি খালে জেলের একটি নৌকায় দেখা মেলে পাখি শিকারের দৃশ্য। ‘বড় কুবো’ একটি পাখি ধরে তার পায়ে দড়ি বেঁধে অন্য পাখি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন এক তরুণ। নৌকার অন্য জেলারা তখন মাছ ধরছিলেন। পরে সেখান থেকে পাখিটি উদ্ধার করে বনের সুপতি স্টেশনে অবমুক্ত করা হয়।
বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৯৯ দশমিক ৪৯৬ হেক্টর এলাকাকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর ২১ বছর পর ২০১৭ সালে আরও ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৫০ দশমিক ৫৮৪ হেক্টর এলাকাকে নতুন করে অভয়ারণ্যভুক্ত করা হয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ দশমিক শূন্য ৮ হেক্টরে।
সুন্দরবনের রামপালের পেড়িখালীর জেলে আহম্মদ হোসেন বলেন, নিষিদ্ধ এলাকা বাড়িয়ে লাভ হলো কী? সেখানে আগের মতোই মাছ শিকার চলছে। অবশ্য এতে লাভ হচ্ছে বন বিভাগের আর নেতাদের।
অভয়ারণ্য এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে ৯১ হাজার ৬৯৩ দশমিক ৯৬২ হেক্টর এলাকা, যার অন্যতম কটকা। ১৯৯৬ সালে বনের এই এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবনের আয়তনের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি এখন অভয়ারণ্যভুক্ত উল্লেখ করে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের সদর সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. শহিদুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, সুন্দরবনের অভয়ারণ্য থেকে সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ। এতে বনের ওপর মানুষের চাপ অনেকটা কমেছে। ফলে বন্য প্রাণী, জলজ প্রাণী, গাছপালাসহ সব ধরনের বনজ সম্পদ বৃদ্ধি পাবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যখন অভয়ারণ্য কম ছিল, তখন জেলেরা বেশির ভাগ জায়গায় নিয়মিত মাছ ধরতে যেতে পারতেন। এখন অভয়ারণ্য বাড়াতে তাঁদের জায়গা কমে গেছে। ফলে অবৈধ লেনদেন করে সেখানে মাছ ধরতে যেতে হচ্ছে। এসব কারণে এখন জেলেদের খরচ আগের তুলনায় তিন গুণ বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই মাছের আধিক্য থাকায় ওই এলাকায় অবৈধ মৎস্য আহরণ চলছে। ফলে হুমকিতে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। প্রমাণ মেলে ২০১১ সালে পাখি গবেষক সায়েম ইউ চৌধুরীর নেতৃত্বে সুন্দরবন এলাকায় বিপন্ন কালামুখ প্যারা পাখির (ইংরেজি নাম ‘ম্যাস্কড ফিনফুট’) ওপর শুরু করা এক গবেষণায়। এই পাখি দেখতে প্রতিবছর বাংলাদেশে আসেন অনেক বিদেশি পর্যটকও। গবেষণায় বলা হয়, আবাসস্থল–সংকটে সারা পৃথিবীতেই কালামুখ প্যারা পাখি হারাতে বসেছে। সুন্দরবনে মূল সমস্যা হলো জেলেদের অপরিকল্পিত মাছ ধরা। চারপাশটা জাল দিয়ে জেলেদের মাছ ধরার সময় পাখিগুলোর বাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ওই গবেষণা দল ১০০ জনের বেশি জেলের সঙ্গে পাখিটি নিয়ে কথা বলছেন। তাঁদের প্রত্যেকেই বলেছেন, জীবনে অন্তত একবার কালামুখ প্যারা পাখি শিকার করে এর মাংস খেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্য, এ পাখি অনেক ভিতু ও লাজুক। কয়েক বছর আগেও সুন্দরবনের কটকা-কচিখালী এলাকায় একটু চেষ্টা করলে এসব পাখির দেখা মিলত। পর্যটকেরাও এর দেখা পেতেন। তবে এক বছর ধরে এই পাখি আর দেখা যাচ্ছে না। কালামুখ প্যারা পাখির জীবনে গহিন সুন্দরবনে জোয়ার-ভাটার বড় প্রভাব আছে। পাখিটি ভাটার সময় খালের পাড়ে খাবার খোঁজে। ছোট মাছ, চিংড়ি, কীটপতঙ্গ আর কাঁকড়া এগুলোর প্রধান খাবার।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন। অপার সৌন্দর্যের এই বন বিশ্ব ঐতিহ্য। একই সঙ্গে বন, জলাভূমি, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয়ে এমন প্রাকৃতিক বন দেখা যায় না। একদিকে এই বন যেমন ঝড়ঝঞ্ঝার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলের মানুষের রক্ষাকবচ। অন্যদিকে লাখো মানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ জীবিকার আধার। তবে মহাপ্রাণ সুন্দরবন রক্ষায় নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে কিন্তু তা সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে কটকা-কচিখালীতে দেখা যেত একটি-দুটি দল মাছ ধরত। তাঁরা মৎস্যজীবী ছিলেন। কিন্তু এখন সেখানে দাদনদাতা হয়ে গেছেন কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা এবং তাঁদের সুন্দরবনের প্রতি কোনো মমতা নেই। ফলে বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ নানা ধরনের অপরাধ বাড়ছেই। এখন ওই নেতারা বন বিভাগের সঙ্গে রফা করেন, আর সাধারণ জেলেরা তাঁদের হয়ে মাছ ধরেন। ফলে কখনো আটক হলে, সাজা হলে হয় নিরীহ জেলেদের। কিন্তু বন বিভাগ বা ওই প্রভাবশালীরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সম্প্রতি পর্যটক পরিচয়ে মাছ কেনার আগ্রহ দেখিয়ে কটকা অভয়ারণ্য এলাকায় মাছ ধরা বাগেরহাটের শরণখোলার এক জেলের সঙ্গে কথা হয়। ওই জেলে বলেন, ‘আমরা রাতের বেলায় মাছ ধরি। সকাল হলেই মাছ বিক্রি হয়ে যায়। আমাগো দাদনদাতারা ভোরে ট্রলারে মাছ নিয়ে যায়।’ তবে কটকা খালসংলগ্ন ছোট দুটি খালের মুখে দিনের বেলাতেও আড়াআড়ি জাল পাতা দেখা গেল।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, চলমান সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনে ইকোলজিক্যাল মনিটরিং, বনের ওপর গবেষণা কার্যক্রম, অবকাঠামো সংস্কার ও নির্মাণ করা হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিভিন্ন খাতে বেড়েছে বন বিভাগের রাজস্ব আদায়। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের তথ্য বলছে, গত ২০১৯-২০, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে মধু আহরণ থেকে বন বিভাগের রাজস্ব আদায় হয়েছে যথাক্রমে ৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা, ৭ লাখ ৮৩ হাজার ও ১১ লাখ ৮০০ টাকা। একই সময় শুঁটকি আহরণ থেকে রাজস্ব এসেছে ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, ৩ কোটি ২০ লাখ ও ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সুন্দরবনকে শুধু রাজস্ব আয়ের জন্য চিন্তা করলে হবে না। দীর্ঘ চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত হলে সুন্দরবন সুরক্ষা কঠিন। সবার আগে বনের ওপর মানুষের চাপ কমাতে হবে। এ জন্য বনের ওপর নির্ভরশীলদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ইকোট্যুরিজমের কথা বললেও আমাদের পর্যটকেরাও কিন্তু বনের ক্ষতি করছেন। ট্যুর অপারেটররাও সবাই সেখানে বন সুরক্ষার বিষয়ে যত্নবান নন। এসব বিষয়ে আরও যত্নশীল না হলে সুন্দরবনেরই ক্ষতি।’
বাপার মোংলার আহ্বায়ক নূর আলম শেখ বলেন, ‘সুন্দরবনকে কোনোভাবেই একটা রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করলে হবে না। এ বন আমাদের বাংলাদেশের ফুসফুস। এই মূল্য তো রাজস্বের বিচারে করলে হবে না। এই বন থেকে দেখা যাবে সরকার সব মিলিয়ে বছরে ১০ কোটি টাকা রাজস্ব পায়। কিন্তু এখানে টাকাটা মুখ্য বিষয় নয়। বনটা আমাদের বাঁচিয় রাখা দরকার, টিকিয়ে রাখা দরকার। রাজস্ব আয় করত গিয়ে যদি বনের ক্ষতি হয়, প্লাস্টিক দূষণ হয়, বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিষ দিয়ে মাছ শিকার হয়—এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাজস্ব না এলেও আমাদের প্রয়োজনেই বনটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’
সূত্র: প্রথম আলো
সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।
Tags: বন সংরক্ষন, সংরক্ষণ, সুন্দরবন
For add