বিলুপ্ত মাছের দেখা পাওয়া যাবে বাকৃবির মৎস্য জাদুঘরে

ছবি: ওশানটাইমস বিডি

মৎস জাদুঘর ও জীববৈচিত্র্য কেন্দ্র যা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের আওতাধীন একটি জাদুঘর। সহজেই মাছের সঙ্গে পরিচিত হতে পারা, বিলুপ্ত এবং বিলুপ্তপ্রায় সব স্বাদু পানি ও সামুদ্রিক মাছ এবং জলজ প্রাণী সংরক্ষণের মাধ্যমে ভবিষ্যত গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে এ জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাদুঘরটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বাংলাদেশে প্রথম ও সর্ববৃহৎ মৎস্য জাদুঘর।

বাংলাদেশের মাছ কেন্দ্রিক সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরা এবং বিপন্ন প্রজাতির মাছগুলোর ব্যাপারে জনমনে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে মৎস্য জাদুঘরের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন।

১০ বছর ধরে গবেষণার কাজে এবং শখের বশে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের নমুনা সংগ্রহ করেন। বাকৃবির মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ বায়োলজি এবং জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা আলী রেজা হোসেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধমে ড.হোসেন নিজ উদ্যোগে ২০০৯ সালে বাকৃবির নয়নাভিরাম সবুজ চত্বরে স্থাপন করেন ‘ফিশ মিউজিয়াম অ্যান্ড বায়োডাইভার্সিটি সেন্টার (এফএমবিসি)’। পরে ২০১০ সাল থেকে এটিকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্ববধানে নেওয়া হয়।

জাদুঘরটি মোট ৫টি কক্ষ নিয়ে সাজানো। এ জাদুঘরটির প্রথম কক্ষটির শিরোনাম ফ্রেশওয়াটার ডলফিন এন্ড ফিশ (মিঠাপানির ডলফিন ও মাছ), দ্বিতীয়টির এনসিয়েন্ট এন্ড মিডিয়া, তৃতীয়টির সিলোরিফরমিস বা বিড়াল জাতীয় মাছ, চতুর্থটির সিপ্রিনিফরমিস বা কার্প জাতীয় মাছ এবং পঞ্চমটির শিরোনাম পার্সিফরমিস বা কই জাতের মাছ। এছাড়াও জাদুঘরের করিডোরে আছে আবহমানকাল ধরে এ দেশের জেলেদের ব্যবহার্য বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার উপকরণ আর দেশের মৎস্য ঐতিহ্যের ইতিহাস ও নিদর্শন।

মাছের নমুনাগুলি বিভিন্ন আকারের কাঁচের জারে ফরমালিনে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি মাছের জার বরাবর ওপরে দেয়ালে সাঁটা পোস্টারে প্রদর্শন করা হয়েছে ঐ মাছেরই পরিপক্ব বয়সের আলোকচিত্রসহ প্রচলিত ও বৈজ্ঞানিক নাম এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। গবেষণা কর্মের সহায়তার জন্য বড় এবং ছোট দেশি প্রজাতির মাছের জন্য অ্যাকোয়ারয়াম, ক্রায়োজেনিক মাছের একটি জিন ব্যাংক এবং ডিএনএ সংগ্রহশালা করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা যায়।

এছাড়াও, একটি কক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে থ্রিডি অডিও-ভিজুয়াল-সুবিধা। কক্ষটিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিলুপ্ত মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবাশ্মের প্রতিলিপি প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। রয়েছে কোটি কোটি বছর আগে বিলুপ্ত প্রাণির কঙ্কাল।

জাদুঘরে প্রায় ৪০টি জীবাশ্ম ও কঙ্কাল সংগৃহীত আছে। এর মধ্যে হাঙরের চামড়া, ৫৪০ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া দুই দাঁতবিশিষ্ট বাঘের কঙ্কাল, ৫৪ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত জলজ প্রাণী গার পাইক, হর্স গ্রাস, স্টিং রের প্রতিলিপি, ১৫ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হাঙরের চোয়াল ও দাঁত, ৩৫ কোটি বছর আগে বিলুপ্ত কোরালের প্রতিলিপি অন্যতম। এই মৎস্য জাদুঘরে স্বাদু পানির প্রায় ২৩০ প্রজাতিসহ রয়েছে হাজার বছরের বিলুপ্ত প্রজাতির ফসিল যা চারটি সুপরিসর গ্যালারিতে সাজানো হয়েছে। ফরমালিনের দ্রবণে বড় বড় কাচের সিলিন্ডারে এই সমস্ত মাছ সংরক্ষিত আছে। প্রতিটি মাছের উপরে দেওয়ালের সাথে টাঙানো আছে নয়নাভিরাম আলোকসজ্জা। আলোকসজ্জার সাথে বৈজ্ঞানিক নামসহ মাছের যাবতীয় বর্ণনা দেয়া রয়েছে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা এখান থেকে পরিপূর্ণ জ্ঞান নিতে পারে।

জাদুঘরটি প্রায় এক একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। নতুন করে আরও পাচঁ একর জমির প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানের জাদুঘরটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ বায়োলজি এবং জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম সরদার। এছাড়া জাদুঘরটির দেখা শোনা করেন মুহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন। জাদুঘরটি প্রতি শনিবার ১০টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

মৎস্য জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা আলী রেজা হোসেন বলেন, এই মৎস্য জাদুঘরটি তৈরির উদ্দেশ্যে হলো বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীসহ সকল মানুষজনকে বাংলাদেশের মাছের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত করা। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যাকে আদিকাল থেকে মাছে ভাতে বাঙালি বলা হয়। দেশে মিঠা পানিতে প্রায় ৩০০ প্রজাতির এবং সমুদ্রে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এমনি অনেক মাছ দেশে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

দেশের মানুষের জীবন যাত্রা এবং খাদ্য-পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে থাকে মাছ। তাই এই মাছের জীবন প্রণালী, মাছগুলো আমাদের কি উপকার করে এসকল বিষয় তরুণ প্রজন্মকে জানানোর জন্যে এখন থেকে প্রায় ২০ বছর আগে এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাছ সংগ্রহ করা করে জাদুঘরে রাখা হয়। প্রথমে মাছগুলোকে ফরমালিনে রেখে পরে অ্যাকোহলে সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রতিটি মাছের নাম, বর্ণনা এবং ছবি দেওয়া আছে। যেটি দেখে সহজেই যেকোনো বয়সের মানুষ মাছ সম্পর্কে জানতে পারবে। মাছ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে দেশের মানুষ এবং শিক্ষার্থীরা এ মাছ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করবে। এতে করে আমাদের মাছের হারানো ঐতিহ্য এবং বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।

 

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , ,

oceantimesbd.com