প্লাস্টিক-পলিথিনের রমরমায় ধুঁকছে পরিবেশ

অনেক আগেই দূষণ কেড়ে নিয়েছে বুড়িগঙ্গার প্রাণ। ওই নদীর তীরে এখন আর নেই ট্যানারি শিল্প। তবে আছে শত শত প্লাস্টিক ও পলিথিন রিসাইক্লিং কারখানা। আশপাশের প্লাস্টিক বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। সম্প্রতি বুড়িগঙ্গায় বিচরণশীল প্রাণীর শরীরে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর প্লাস্টিকের কণার অস্তিত্ব পেয়েছেন গবেষকরা।

ঢাকার চারপাশের প্রায় সব নদীর একই হাল। আর ঢাকার ‘ফুসফুস’খ্যাত হাতিরঝিলে এখন দম নেওয়াটাও কষ্টের। সেখানে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, পানি শোধনের যন্ত্রও কাজ করছে না বলে জানাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

ঢাকায় হাতেগোনা যে কয়েকটি লেক আছে, সেগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। বেড়াতে আসা মানুষের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক আর খাবারের দোকানের বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে লেকের পানি। কর্ণফুলী ও সুরমার মতো একসময়ের টলমলে পানির নদী এখন প্লাস্টিকের কারণে মারাত্মক দূষিত। দেশের অন্য নদীর দূষণচিত্রও অভিন্ন।

পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিষ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না কৃষিজমি। মাটি হারিয়ে ফেলছে উৎপাদন ক্ষমতা। পরিবেশবিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, মাটি, পানি, বায়ু– সবখানেই প্লাস্টিকের দূষণ চলছে। ৫০০ বছরের বেশি সময় টিকে থাকতে সক্ষম প্লাস্টিক একপর্যায়ে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়, যা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের দেহে ঢুকে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

এ পটভূমিতে প্রতিবছরের মতো আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দিবসে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য– ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’।

প্রতিবার দিবস এলেই পলিথিন ও প্লাস্টিক নিয়ে শুরু হয় শোরগোল। তবে ফলশূন্য। বরং বছর বছর বাড়ছে নিষিদ্ধ পলিথিনের কারখানা, বাড়ছে প্লাস্টিক দূষণ। এবারও সরকার নিয়েছে নানা উদ্যোগ, ব্যাপক কর্মসূচি।

গতকাল রোববার সচিবালয়ে পরিবেশ দিবস ঘিরে সংবাদ সম্মেলনে খোদ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্লাস্টিকের ভয়াবহতা তুলে ধরে। মন্ত্রণালয় জানায়, করোনা শুরুর পর পরিচ্ছন্নতা সামগ্রীর কারণে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েছে। দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টনের মতো পুনর্ব্যবহার (রিসাইকেল) হয়। বাকি বর্জ্য পরিবেশে পড়ে থাকে।

রাজধানীতে বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন, অর্থাৎ দিনে ৬৮১ টনের মতো বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সারাদেশে দিনে এর পরিমাণ ২ হাজার ২৫০ টন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ৯ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন করলেও রাজধানীতে এটি দ্বিগুণ অর্থাৎ ১৮ কেজি।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ বলেন, দেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের ৬০ শতাংশ রাস্তাঘাট ও নদীতে যাচ্ছে। মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে ঢুকে সেগুলো মানুষের জীবনচক্র ও শরীরে চলে আসছে। সরকার এমন একটি বিধান করতে যাচ্ছে, যাতে যারা বর্জ্য উৎপাদন করবে তারাই উৎস থেকে সেটি ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করবে।

একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক সবচেয়ে ভয়াবহ উপকূলীয় এলাকার হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁয় একবার ব্যবহারের পর বর্জ্য হয়ে যায় এমন প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনা আছে হাইকোর্টের। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০২১ সালের মধ্যে এই ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে আদেশ দেন হাইকোর্ট।

তবে দুই বছর কেটে গেলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি হাইকোর্টের এ আদেশ প্রতিপালনে কোনো প্রতিবেদনও জমা দেয়নি অধিদপ্তর। ফলে গত ২৩ জানুয়ারি বেলাসহ ১০ সংগঠন ওয়ানটাইম প্লাস্টিক বিক্রয়-ব্যবহার বন্ধের ব্যর্থতায় সরকারকে আদালত অবমাননার নোটিশ দেয়। তবে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। ফলে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশে রয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিন গুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে। সেখান থেকে নালা ও খাল হয়ে নদীতে পড়ছে। সর্বশেষ ঠাঁই হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। নদী হয়ে সাগরে যাওয়া প্লাস্টিক ও পলিথিন। দূষণে বাংলাদেশ বিশ্বে এখন ষষ্ঠ।

অন্য দেশের প্লাস্টিকেও বাংলাদেশের নদী দূষিত হচ্ছে। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) গত বছরের এক গবেষণায় বলেছে, ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের ১৮টি আন্তঃসীমান্ত নদীতে দিনে প্রায় ১৫ হাজার ৩৪৫ টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ঢোকে। সংস্থাটির সাম্প্রতিক আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর দেশে ১ লাখ ৯২ হাজার ১০৪ টন প্লাস্টিক মিনিপ্যাক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক প্রায় ১৩ কোটি বা ১২৯ মিলিয়ন মিনিপ্যাক বর্জ্য ব্যবহার করে।

নিষিদ্ধের ২১ বছরেও বন্ধ হয়নি পলিথিন

বাংলাদেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেই সঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়। ২০০২ সালের পর তিন-চার বছর পলিথিন ব্যবহার সীমিত হলেও বর্তমানে যত্রতত্র অবাধে ব্যবহার হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে শপিংমলে অবাধে চলছে ব্যবহার।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য বলছে, দেশজুড়ে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় ১ হাজার ২০০ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকার অলিগলিতে রয়েছে অন্তত ৩০০ কারখানা।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে ধান, চাল, ভুট্টা, সার, চিনিসহ ১৯টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তখন কিছু অভিযানও চালানো হয়। পরে সেই উদ্যোগের আর সুফল মেলেনি। আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মোবারক আহমদ খান ২০১৬ সালে ‘সোনালি ব্যাগ’ উদ্ভাবন করেন। তাঁর এ আবিষ্কার ব্যাপক সাড়া ফেলায় ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনা যায়নি সোনালি ব্যাগ।

স্বাস্থ্যঝুঁকি

প্লাস্টিক মানুষের জীবন সহজ করলেও ওই প্লাস্টিকই জীবন গিলে খাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় সে প্রমাণ মিলেছে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের নেতৃত্বাধীন গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা জলাশয়ে পড়ছে। এই প্লাস্টিক মাছ খাচ্ছে। আবার মানুষ অজান্তেই মাছের মাধ্যমে প্লাস্টিক খাচ্ছে। অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় ধানমন্ডি লেক ও বুড়িগঙ্গার মাছে পলিথিনের অণু পেয়েছি। এ ছাড়া ২০১৯ সালে এক গবেষণায় দেখেছি, উপকূলীয় এলাকায় ৪২ কিলোমিটার সময়াতন পানিতে প্লাস্টিক বর্জ্য ভাসমান আছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে ১৫ প্রজাতির দেশি মাছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণার (মাইক্রোপ্লাস্টিক) অস্তিত্বের কথা জানিয়েছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানীর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের আরেকটি গবেষণায় সামুদ্রিক লবণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পান।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে মুনাফা করা কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজ হতে পারে না। উৎপাদকদের এর বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণের ভয়াবহতা উল্লেখ করে বলেন, ঢাকা শহরের মোট বর্জ্যের ২০-৩০ শতাংশই প্লাস্টিক। ফলে যেখানেই বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে সেখানে প্লাস্টিকও পুড়ছে। এতে বাড়ছে বায়ুদূষণ। প্লাস্টিকের পুড়ে যাওয়া অংশ মাটি-পানিতেও মিশছে।

প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কমাতে সচেতনতার ওপর জোর দিয়ে ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, প্লাস্টিক-পলিথিন জীবন ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি, তা মানুষকে বোঝাতে হবে। ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। ব্র্যাকের অফিসগুলো এখন প্লাস্টিকমুক্ত। শুধু ব্র্যাক নয়, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত। যে পরিবর্তন শুরু হয়েছে, তা সচেতনতার মাধ্যমে আরও এগিয়ে যাবে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, প্লাস্টিকের উৎপাদন নিষিদ্ধ করা আছে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত নাগরিকদের চাহিদা থাকবে এবং তাঁরা সচেতন না হবেন, ততক্ষণ এটা চলতে থাকবে। ২০২৬ সালের মধ্যে একবার ব্যবহৃত হয়, এমন প্লাস্টিক বন্ধের পরিকল্পনা নিয়েছি। আশা করছি, এর মধ্যেই একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ব্যবহার ৮০ শতাংশ কমাতে পারব। ঢাকায়ও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের চেষ্টায় পাট থেকে ব্যাগ তৈরির ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখনও সেটি বাজারজাত করা যায়নি। আমরা যখন বাজারজাত করতে পারব তখন ঢাকায় পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে পারব।

সূত্র: দৈনিক সমকাল

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , , ,

oceantimesbd.com