বাকৃবিতে গড়ে তোলা হয়েছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর

প্রাচীন ও বর্তমান কৃষি ও কৃষি প্রযুক্তি সংরক্ষণ, প্রদর্শন এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জাতীয় চেতনা ও উপলব্ধিকে জাগ্রত করে কৃষির বিবর্তন ও ক্রমবিকাশের পরিষ্কার ধারণা দিতেই গড়ে তোলা হয়েছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর। জাদুঘরটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসের বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে সবুজ ছায়াঘেরা দেবদারু গাছের মনোরম পরিবেশে অবস্থিত।

বাকৃবি সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ হোসেন স্বপ্ন দেখেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি কৃষি জাদুঘর গড়ে তোলার। তারই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মু. মুস্তাফিজুর রহমান জাদুঘরটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। জনবল সংকট ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক কারণে এটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও অবশেষে ২০০৭ সালের ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ জাদুঘরটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করেন। জাদুঘরটির বর্তমানে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন ফসল উদ্ভিদ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুজ্জামান এবং কৃষিবিদ মনির উদ্দীন আহাম্মেদ ও কৃষিবিদ মো. মেহেদী হাসান রাসেল সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাঁচ একর আয়তনের দৃষ্টি নান্দনিক এই জাদুঘরে রয়েছে একটি অষ্টাভুজ আকৃতির ভবন।

জাদুঘরে প্রবেশের পরেই চোখে পড়বে বিচিত্র সব মাছের অ্যাকুইরিয়ামসহ প্রাচীন সাতটি খনার বচন। সাথেই রয়েছে দুটি অফিস কক্ষ। আর একটু ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে বৃত্তাকৃতির বাগান যার উপরি ভাগ ছাদহীন প্রাকৃতিক আলোয় বিজরিত। তারই চারদিকে সংক্ষরণশালার বিভিন্ন কক্ষ। কক্ষগুলোতে রয়েছে নাম জানা-অজানা উপকরণের সমাহার। এই সব উপকরণের আঞ্চলিক নাম, বৈজ্ঞানিক নাম, সংগ্রহের উৎস, ব্যবহার ইত্যাদি উল্লেখ রয়েছে যা থেকে শিক্ষার্থীরা এবং পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে পারে।

রয়েছে বীজের এক বিশাল সংগ্রহশালা। বিভিন্ন জাতের ধান, গম, ভুট্টা, চীনাবাদাম, কাউনধান, তিসি, ফ্রাঞ্চ বিন সিড, ফাবা বিন সিডসহ নানান ফল ও সবজির বীজ। তাছাড়া রয়েছে বিরল প্রজাতির তৈকর। যা ব্যবহৃত হয় আচার, জেলী তৈরিতে। এটি তরকারি হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এই প্রাচীন ফল তৈকর।

এছাড়াও রয়েছে বহুল পরিচিত ভ্যান্নার বীজ। এর তৈল দিয়ে কসমেটিক তৈরি করা হয়। এর ঔষধি গুণাগুণ ও রয়েছে অনেক। বীজ যেহেতু বুনতে হয় মাটিতে সেটা কি আর বলতে হয়? তাইতো রয়েছে বিভিন ধরনের মাটির সেম্পল আর সে বীজে শক্তি যোগান দিতে সাথেই রয়েছে অনেক রকমের সার। আরও চোখে পড়বে পাহাড়ি চাষাবাদের মডেল, বিভিন্ন রোগের চিত্রসহ বর্ণনা, বিভিন্ন মসলার উপকরণ, তেল বীজ, ঔষুধি ফল ও পাতা। এই কক্ষের বিশেষ আকর্ষণে রয়েছে আড়াই কেজি ওজনের মিষ্টি আলু। এর পাশেই রয়েছে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত ফসলের নমুনাসমগ্র।

এই নমুনা বীজগুলোর সিংহভাগই সংগ্রহ করা হয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) থেকে। এছাড়া প্রদর্শনীতে রয়েছে গ্রাম বাংলার বিয়েতে ব্যবহৃত অতীত ঐতিহ্য সামগ্রী ‘গিলা’। বর্তমান যুগের তরুণ সমাজের অনেকেই হয়তো চিনবে গিলা দেখলে; তবে ইহা এক সময় বর কনের গোসলের সময় ব্যবহৃত হতো যা অনেকেরই অজানা। এছাড়া রয়েছে যান্ত্রিক কৃষির প্রাচীন সামগ্রী যেমন হরতকি, বিলম্বী যেগুলো নাম শুনেই বর্ণনা পড়তে কেউ ভুলে না।

অন্য কক্ষে রয়েছে প্রাণীর কংকাল, বুনো মহিষ, গরু সহ হরিণের শিং। দৃষ্টি আকর্ষণে রয়েছে অজগর সাপের কংকাল সেই সাথে রয়েছে সংরক্ষিত দুই ফুট লম্বা কালো মেটো ইঁদুর। পাশেই প্রিজার্ভডকৃত গোখরা সাপের ও ধারাইজ নমুনা গুলো যেন জানান দেয় এই দেশ প্রকৃতির কত বৈচিত্র্য প্রাণীর সমাহার নিয়ে গঠিত। কক্ষের মাঝে প্রদর্শিত হয়েছে এই ভূখন্ডে বিভিন্ন সময় ব্যবহৃত মুদ্রা। মুদ্রাগুলো দেশে বিভিন্ন ঔপনিবেশের একটি ছোট্ট বিবৃতি দেয়।

ওপর পাশে তাকালেই দেখা যাবে বিশাল আকার শকুনের প্রিজার্ভডকৃত মডেল। কচ্ছপের কংকাল ও খোল রয়েছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। আরও রয়েছে বিরল প্রাণী প্লাটিপাসের কংকাল এবং দেশীয় প্রাণী বেজি, উদ সহ নানান প্রজাতির প্রানী। চোখে পড়ার মতো রয়েছে লোহাকাঠ যা এক সময় দরজার চৌকাঠে ব্যবহৃত হতো। এখন লোহাকাঠ দিয়ে রাইফেলের বাট, গাড়ির বডি সহ অনেক রকম টেকসই সামগ্রীতে ব্যবহার করা হয়।

আরেক কক্ষে স্থান পেয়েছে বহুদিন ধরে বাংলায় গৃহস্থলীর কাজে ব্যবহৃত উপকরণ। তার মধ্যে রয়েছে ঢেকি, কুলা, মুরগির খাঁচা, দাবা, হুকা, পানের ডাবর, গরুর গাড়ির মডেল, জিপসী, হরেক রকমের হারিকেন, গাছা, কুপি বাতি, মাছ শিকারের প্রাচীন থেকে শুরু করে আধুনিক যন্ত্রাদি, বেহালা, তবলাসহ বিভিন্ন দেশীয় বাদ্যযন্ত্র। রয়েছে প্রযুক্তি বিবর্তনের ধারাবাহিকতার অনন্য প্রদর্শন তা হলো মাইক্রোকম্পিউটার। বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণে রয়েছে আদুরী (সিঙ্গা বিশেষ যা দিয়ে পূজার উৎসব ও মৃত্যু সংবাদ জানানোর জন্য ব্যবহার হতো), ডামা ও ক্রাম ( যা মাতা ও মেয়ের প্রতীকি বাদ্য বিশেষ), নাতক ( নাতনীর প্রতীকি বাদ্যযন্ত্র)। চতুর্ভুজাকার কক্ষের পশ্চিম দেয়ালে সজ্জিত বিশাল উড়োজাল যা বাংলার জেলেদের ঐতিহ্যেও নিদর্শন।

এ কক্ষে দেখা মিলবে কৃষক গৃহিনীর দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য সামগ্রী- তারপাতার পাখা, বাশেঁর পাখা, খন্চাসহ ইত্যাদির প্রদর্শনী। এছাড়াও এখানে স্থান পেয়েছে জমি চাষাবাদের যন্ত্রপাতি এবং পূর্বে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক যন্ত্রাদি যেমন দা, হুক্কা, কোদাল, তাগল/দা, শাবল, মাইক্রোকম্পিউটার, তীর, ধনুক, ইথিস্কোপ, ডট প্রিন্টার ইত্যাদি যন্ত্রপাতি। গ্রামবাংলার নারীদের নিপুন দক্ষতার এক শিল্প শৈলীর উদাহরণ শীতল পাট্টি/ হোগলা পাট্টি বুনন।

এছাড়া রয়েছে কৃষকের বসতবাড়ির মডেল। যা দেখতে হুবহু গ্রাম বাংলার কৃষকেরা পূর্ণাঙ্গ বসত বাড়ির মতন। এখানে দেখা যায় কৃষকের হাল চাষের মডেল, কৃষক গৃহিনীর রান্নার সাজসজ্জ্বা। এছাড়া রয়েছে পালকি, মলন/ধান মাড়াই, লাঙ্গল ইত্যাদি।

সর্বশেষ কক্ষে রয়েছে জমি চাষাবাদের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিস্বরূপ পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি,ঘাণি ইত্যাদি লোচন কাড়া উপকরণ। আরও রয়েছে বাংলার ডিঙি ও কাঁঠের তৈরি নৌকা ও তাল গাছের কুন্দা, গাঁয়ের কাঁচা পথে চলা গরুর গাড়ি। দেয়ালের বিস্তৃত অংশ জুড়ে সাজানো হরিণের চামড়া। অন্য এক দেয়ালে সাজানো রয়েছে উপজাতিদের পোশাক। আনা হয়েচে বরমী অঞ্চল থেকে সংগ্রহকৃত ‘দোন’ যা নিচু জমি থেকে ফসলে পানি সেচ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়।

কৃষি সংশ্লিষ্ট সংগ্রহশালা বাংলাদেশের কৃষির প্রাচীন ইতিহাসকে যেমন ধরে রাখে তেমনি দর্শনার্থীদের দেয় অসীম আনন্দ। জাদুঘরটি পরিদশর্নের মাধ্যমে শহরের ইট পাথর কাঁচঘেরা মানুষেরা খুব সহজেই গ্রামবাংলার প্রকৃতির হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য এক নজরে উপভোগ করতে পারেন। তারা কৃষির ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। জাদুঘরটি শুধু শনিবার ছাড়া বাকি দিনগুলিতে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , ,

oceantimesbd.com