চলুন ঘুরে আসি শত শত গাছের সমারহ বাকৃবি বোটানিক্যাল গার্ডেন

ময়মনসিংহের একসময়ের প্রবল খরস্রোতা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে বড় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত গাছের সমারহে বোটানিক্যাল গার্ডেন। এখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অঞ্চলের বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় কয়েক হাজার উদ্ভিদের বিশাল সংগ্রহশালা।

দেশি প্রায় সব প্রজাতির উদ্ভিদের পাশাপাশি বিদেশি অনেক বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। ছোট-বড়-মাঝারি ধরনের অসংখ্য গাছে ভরপুর গার্ডেনে রয়েছে প্রায় ১০০০ বড়, ১২৭৮ মাঝারি ও ৪৪৬৭টি ছোট গাছসহ প্রায় ৬০০ প্রজাতির উদ্ভিদ। আন্তর্জাতিক সংস্থা বোটানিক গার্ডেনস কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল (বিজিসিআই) কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন এটি। তাই তো এ গার্ডেনটিকে একনজর দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসে। যা বিমোহিত করে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের।

বাগানের প্রধান দায়িত্বে রয়েছেন একজন কিউরেটর। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের মধ্য থেকে একজন গার্ডেনের কিউরেটরের দায়িত্ব পান। তার তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয় গার্ডেনটি। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ গাছালি সহজে খুজে পাওয়ার জন্য উদ্ভিদরাজি সমন্বয়ে গঠিত গার্ডেনটি ৩০টি জোনে বিভক্ত করা হয়েছে।

ওষুধি, ফুল, ফল, ক্যাকটাস, অর্কিড, পাম, সাইকাস, মসলা, টিম্বার, বাঁশ, বেত, বিরল উদ্ভিদ ও বনজ উদ্ভিদ জোনসহ জলজ উদ্ভিদ (হাইড্রোফাইটিক) সংরক্ষণের জন্য ওয়াটার গার্ডেন, মরুভূমি ও পাথুরে অঞ্চলের উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য রক গার্ডেন গড়ে তোলা হয়েছে। বাগান পরিচালনার জন্য ভেতরে রয়েছে দুই তলা অফিস কক্ষ। অফিস কক্ষ সংলগ্ন নিসর্গ ভবনের ভেতরে রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় অসংখ্য প্রজাতির ক্যাকটাস। এর অপরূপ সৌন্দর্যই যেন নিসর্গ নামের সার্থকতা বহন করছে। বাগানের সর্ব দক্ষিণের রয়েছে মনোরম অর্কিড হাউস। তবে বেশি দেখা পাওয়া যাবে দেবদারু গাছের।

পাম সাইকাড জোন: ৩৩ ধরনের পাম গাছ নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পাম সাইকাস গার্ডেন জোন। দর্শনাথীরা সারা পৃথিবীতে জন্মে থাকা পামগুলো এখানে একসাথে দেখতে পারবেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সুগার পাম, তাল, ফিশটেইল পাম, বনসুপারি, ক্যামোডোরা পাম, তালি তাম, অয়েল পাম, চায় পাম, বোতল পাম, সালাক পাম, ওয়াশিংটন পাম, জামিয়া পাম প্রভৃতি।

সুন্দরবন জোন: সুন্দরবনের মতো করেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যাতিক্রমধর্মী সুন্দরবন জোন। যা বাংলাদেশে প্রথম ও একমাত্র। শ্বাসমূল (নিউমেটাফোর) ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদসমূহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা এখানে সংরক্ষিত। সুন্দরবনের সুন্দরি গাছও এখানে পাওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে গরান, গেওয়া, কেওড়া, পশুর, বাইন, হোগলা ও ফার্ণ জাতীয় নানা প্রজাতির উদ্ভিদ।

ওষুধি গাছের জোন: অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, গন্ধভাদুলি, পুনর্নভা, কুর্চি, বচ, উলটচন্ডাল, অন্তমূল, অঞ্জন প্রভৃতি ঔষুধি গাছ এখানে স্থান পেয়েছে। যা থেকে দর্শনার্থীরা সহজেই এ সব গাছগাছালি সম্পর্কে ধারণা পাবে।

এছাড়া রয়েছে বিদেশী, দেশি ফুল ও ফলের গাছ। কমব্রিটাম, রনডেলেসিয়া, পালাম, ক্যামেলিয়া, আফ্রিকান টিউলিপ, ট্যাবেবুঁইয়া, রাইবেলি, জেসিয়া, ডায়ান্থাস, সিলভিয়া, হৈমন্তি বিভিন্ন ধরণের ফুল গাছ এবং স্টার আপেল, আমেরিকান পেয়ারা, থাই মালটা, আঙুর, প্যাসান ফলসহ বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফলের গাছ এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়াও বাঁশ বাগানে রয়েছে ১৬ প্রজাতির বাঁশ, মসলা জোনে রয়েছে একশ’র বেশি মসলা জাতীয় উদ্ভিদ।

নাগলিঙ্গম: নাগলিঙ্গম একটি অপরিচিত বৃক্ষ। গাছের গোড়া ফুঁড়ে বের হওয়া লম্বা লতার মতো শাখায় ছোট ছোট হাজারো কুঁড়ি। কুঁড়ি থেকে টকটকে লাল পলাশ কিংবা শিমুলের মতো ফুল মুখ বের করে আছে আকাশের পানে। নাগলিঙ্গম ফুলের পাপড়ি, রেণু, গঠন মোহনীয়। পাপড়ির মাথায় অসংখ্য ছোট ছোট সাপের মতো ফণা। এর আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার গভীর বনাঞ্চলে। গাছ সাধারণত ১০-৩০ মিটার লম্বা হয়। গোড়ায় বেলের মতো শত শত ফল হয়। একই সঙ্গে ফুল, ফল ও গাছের পাতা আলাদা বৈশিষ্ট্যের। নাগলিঙ্গম গাছ সাধারণত কাঠবৃক্ষের মতো হলেও অন্যান্য জাতের গাছের মতো এর শাখায় নয় বরং ফুল ফোটে গুঁড়িতে। এ ফুল সচরাচর দেখা যায় না। নয়নকাড়া ফুল আর বিচিত্র গোলাকার ফলের মনকাড়া সৌন্দর্য বিমোহিত করে।

বিরল উদ্ভিদের সংগ্রহশালা: কনজারভেটিভ উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে বেশ কিছু বিলুপ্ত উদ্ভিদ। এসব উদ্ভিদের মধ্যে এমন কিছু উদ্ভিদ আছে, যা কেবলমাত্র এ গার্ডেনেই দেখা যায়। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে- রাজ-অশোক, ডেফল, কালাবাউস, ক্যারিলিম্ফ, ফলসা, মনহোটা, মাক্কি, পেয়ালা, বনভুবি, লোহাকাট, উদাল, পানবিলাস, টেকোমা, বহেরা, হরতকি, কাটাসিংড়া, ম্যালারিউকা, প্যাপিরাস, রাইবেলি, রুপিলিয়া, স্ট্যাভিয়া, হিং, পেল্টোফোরামসহ বিভিন্ন উদ্ভিদ।

পট হাউস: এখানে রয়েছে বিরল প্রজাতির হার্ব জাতীয় ওষুধি ও সুগন্ধি জাতীয় উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য পট হাউস। এখানকার ওষুধি জোনে রয়েছে অর্ধশতাধিক প্রজাতির ওষুধি উদ্ভিদ। এর মধ্যে আপাং, পেটারি, বাসক, উচান্টি, ঈশ্বরমূল, রইনা, দাঁদমর্দন, হুরহুরিয়া, মূতা, কালাহুজা, অতশি, স্বর্ণলতা, চাপড়া, হরিনা, আসামলতা, জির, উলটচন্ডাল, ফলসা, তোকমা, জ্যাট্রোফা, লাল রিয়া, মহুয়া, নাগকেশর, জয়ত্রী, কালিজিরা, রক্তচিতা, সর্পগন্ধা, দুধকরচ, ইন্দ্রযব প্রভৃতি। পট হাউসসহ গার্ডেনের সব ওষুধি গাছ নিয়ে একটি প্রকাশনা রয়েছে। এতে কোন ওষুধি গাছ কী কাজে ব্যবহৃত হয় তার বর্ণনা ও ছবি রয়েছে।

ক্যাকটাস-সাকুলেন্ট হাউস: বাগানের পূর্ব দিকের সীমানা ঘেঁষে ২০১০ সালে নির্মিত হয় একটি ক্যাকটাস হাউস। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় ৬০ এর অধিক প্রজাতির ক্যাকটাস নিয়ে সাজানো হয় হাউসটি। ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ক্যাকটাস এক ধরনের ফণীমণসা জাতীয় উদ্ভিদ। এদের পর্ণকাণ্ড রূপান্তরিত হয়ে পাতা ও কাণ্ডে পানি সঞ্চয় করে। ক্যাকটাসের পুরো দেহ থাকে কাঁটায় আচ্ছাদিত।

গবেষণা কার্যক্রম: বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম, স্নাতক পর্যায়ে বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীদের উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন এবং মাস্টার্স ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের গবেষণা কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পরিচিত করানো হয় বাগানের সঙ্গে। ব্যবহারিক ক্লাসে উদ্ভিদ চেনার জন্য এখানে আসতে হয় শিক্ষার্থীদের। পরীক্ষার সময় উদ্ভিদ তথা উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফল, বীজ শনাক্তকরণের ওপর নম্বর রয়েছে। এছাড়াও দেশের সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়ের শিক্ষার্থীরা উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে জানতে ও দেখতে এখানে আসেন।

যেভাবে যাবেন: ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ৫ মিনিট পরপর ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ে। এনা, শ্যামলী বাংলা, আলম এশিয়া, সৌখিন, সোনার বাংলা প্রভৃতি বাসে চড়ে আসতে পারেন। সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। এছাড়া আপনি ট্রেনে চড়েও আসতে পারেন। বাসে আসলে ময়মনসিংহ এসে মাসকান্দা বা ব্রিজ মোড় নামিয়ে দিবে। মাসকান্দা হতে ক্যাম্পাসে আসতে অটোতে সবোর্চ্চ ভাড়া ২০ টাকা এবং ব্রিজ মোড় থেকে অটোতে ১০ টাকা লাগবে।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

oceantimesbd.com