কেন বলা হয় সমুদ্রের আরেক নাম রত্নাকর!

সমুদ্রের বিশাল সম্পদের বিবরণ এ নিবন্ধে দেয়া সম্ভব নয়। তাই তুলনামূলক অর্থবহ কয়েকটি সম্পদের প্রসঙ্গে এখানে আলোকপাত করা হয়েছে এবং সাগরে ৪০টির বেশি খনিজ পদার্থ ও ধাতু রয়েছে।

এক মনীষী বলেছিলেন, ‘It is wonder of the ocean that it is full of water’. কিন্তু আরও আশ্চর্যের সঙ্গে বলতে হয়, সমুদ্রে শুধু পানিই নয়, আছে মানুষের আহার্যসামগ্রী, রকমারি উদ্ভিদ, খনিজপদার্থ, ধাতু এবং জ্বালানিশক্তির উৎস অফুরন্ত তেল ও গ্যাসের বিস্তৃত ভাণ্ডার।

প্রতি ঘনমাইল সমুদ্রের পানিতে গড়ে ১৬৬ মিলিয়ন টন এবং পৃথিবীর সব সমুদ্র এলাকাজুড়ে বিভিন্ন রকমের প্রায় ৫০ কোয়াড্রিলিয়ন টন দ্রবীভূত খনিজ লবণ রয়েছে।

এসব খনিজপদার্থ ও ধাতুর মধ্যে ক্লোরাইড (১৮,৯৮০ পিপিএম), সোডিয়াম (১০,৫৬১ পিপিএম), ম্যাগনেসিয়াম (১২৭২ পিপিএম), সালফার (৮৮৪ পিপিএম), ক্যালসিয়াম (৪০০ পিপিএম), পটাশিয়াম (৩৮০ পিপিএম), ব্রোমিন (৬৫ পিপিএম), অজৈব কার্বন (২৮ পিপিএম) ও স্ট্রনসিয়াম (১৩ পিপিএম) উল্লেখযোগ্য।

এর পরে রয়েছে বোরন, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, লিথিয়াম, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, কপার, আয়োডিন, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, ইউরেনিয়াম, স্বর্ণ ইত্যাদি।

লবণ মানুষের খাদ্য তালিকায় আবশ্যকীয় একটি উপকরণ। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ বছরে গড়ে ৮ কিলোগ্রামের বেশি এ লবণ খাদ্যের সঙ্গে ব্যবহার করে। তবে মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান আয়োডিন টেবিল লবণের চেয়ে বেশি মাত্রায় পাওয়া যায় আয়োডাইজড লবণে।

মানুষের শরীরে নানা রোগ-প্রতিরোধে এবং পুষ্টি সরবরাহের জন্য ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এছাড়া মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনেও এ খনিজ উপাদানগুলোর চাহিদা রয়েছে।

ক্যালসিয়াম ব্যবহৃত হয় অ্যালুমিনিয়াম, বেরিলিয়াম, কপার, সিসা ও ম্যাগনেসিয়ামের সঙ্গে ধাতব সংমিশ্রণ বা খাদ হিসেবে। ক্যালসিয়াম কার্বনেট সিমেন্ট ও গ্লাস ফ্যাক্টরিতে এবং টুথপেস্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

পটাশিয়ামের যৌগ পটাশিয়াম ক্লোরাইড সার তৈরিতে এবং পটাশিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড সাবান, ডিটারজেন্ট ও নর্দমা পরিষ্কারকারী তরল পদার্থ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ম্যাগনেসিয়াম ব্যবহৃত হয় গাড়ির আসন, লাগেজ, ল্যাপটপ, ক্যামেরা এবং লৌহ ও ইস্পাত গলানোর কাজে।

এ ছাড়া হালকা উড়োজাহাজ নির্মাণে এবং আতশবাজি ও সংকেতশিখা (Flare) তৈরিতেও ম্যাগনেসিয়ামের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

সাগরে খনিজ লবণের মজুদের ক্ষেত্রে ম্যাগনেসিয়ামের পরই সালফারের স্থান। গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান সালফিউরিক এসিড উৎপাদনের ক্ষেত্রে সালফার হচ্ছে প্রধান উপাদান। এ ছাড়া সালফারের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে; যেমন- অলৌহঘটিত (Non-ferrous) ধাতু ও ইস্পাত কারখানায়, পানি শোধন প্রক্রিয়ায়, হাইড্রোফ্লোরাইড এসিড ও কার্বন ডিসালফাইড উৎপাদনে এবং ওষুধ, কীটনাশক, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসংক্রান্ত সামগ্রী, প্রসাধন দ্রব্য, রঞ্জক ও তন্তু তৈরিতে সালফার ব্যবহৃত হয়।

গভীর সমুদ্রে ৬৫ পিপিএম ব্রোমিন থাকলেও উপসাগর ও সল্টলেকে অধিক মাত্রার- ২,৫০০-১০,০০০ পিপিএম- ব্রোমিন আছে বলে জানা যায়। কৃষিজাত রাসায়নিক পদার্থ, কীটনাশক, ওষুধ ও রং প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে ব্রোমিন ব্যবহৃত হয়।

পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আবশ্যকীয় উপাদান, ইউরেনিয়ামের মজুদ সমুদ্রে প্রায় ৪ বিলিয়ন টন। মজার বিষয় হল, ইউরেনিয়াম নবায়নযোগ্য সম্পদ অর্থাৎ উত্তোলনের ফলে যখন এর মজুদের ঘাটতি হয়, তখন এ উপাদানের ধারক শিলা ও পানির পারস্পরিক বিক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম আপনাআপনি তৈরি হতে থাকে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, কাজাখস্তান, রাশিয়া, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া ও চীনে পর্যাপ্ত ইউরেনিয়ামের রিজার্ভ রয়েছে।

বিশ্বে জ্বালানি তেলের গুরুত্ব অপরিসীম। সাগরের তলদেশে যুগ যুগ ধরে চাপাপড়া মৃত প্রাণী ও উদ্ভিদের সমন্বয়ে গঠিত হাইড্রোকার্বন এবং অন্যান্য জৈব যৌগের পারস্পরিক বিক্রিয়ার ফলে অপরিশোধিত তেলের সৃষ্টি হয়।

এ অপরিশোধিত তেল শোধন বা বিশুদ্ধ করে ‘তরল সোনা’ বলে অভিহিত পেট্রোলিয়াম উৎপাদন করা হয়। পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে গ্যাসোলিন এবং শোধনকৃত তরল পদার্থ যেমন- ডিজেল, জেটের জ্বালানি, পেট্রোকেমিক্যাল, মোম, লুব্রিক্যান্ট এবং বিটুমিন বা পিচ। সমুদ্র থেকে ব্যাপক হারে তেল উত্তোলনকারী দেশ হচ্ছে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, মেক্সিকো, নাইজার, ভেনিজুয়েলা ও কলোম্বিয়া।

বর্তমানে সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন প্রায় ৯৫ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়। সৌদি আরবের উপকূলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেলক্ষেত্রে ৫০ বিলিয়ন ব্যারেলের অধিক তেলের মজুদ রয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত কর্মসূচির ফলে বঙ্গোপসাগরে গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামের ৩৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘সাঙ্গু’ গ্যাসফিল্ড থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়।

এ ছাড়া খনিজ উপাদান হিসেবে আমাদের সাগর থেকে কেবল লবণই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। অন্যান্য উপাদানের মধ্যে যেগুলো অতি উপকারী ও মূল্যবান সেগুলোর বিদ্যমানতা ও মজুদের ব্যাপারে ফলপ্রসূ কার্যক্রম গ্রহণ যায় কিনা, তা সরকারের সবিশেষ বিবেচনার বিষয়।

আকর্ষণীয় ও মূল্যবান ধাতু স্বর্ণ রয়েছে সাগরজলে। উল্লেখ্য, সাগর থেকে স্বর্ণ উত্তোলন যেমন সহজসাধ্য নয়, তেমনি তা অনেক ব্যয়বহুল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে জার্মানি বিজয়ী দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ পরিশোধের জন্য সাগর থেকে স্বর্ণ উত্তোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল।

কিন্তু দক্ষিণ আটলান্টিকে প্রায় ৪ বছর ধরে কার্যক্রম চালানোর পর দেখা গেল, যে পরিমাণ স্বর্ণ তারা আহরণ করেছে তার মূল্যের চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজে। প্রতি ঘনমাইল সাগরজলে প্রায় ২৫ টন এবং প্রতি লিটার সাগরজলে প্রায় এক গ্রামের ১৩ বিলিয়ন্ত স্বর্ণ মজুদ রয়েছে। সমুদ্রের তলদেশেও প্রচুর স্বর্ণ মজুদের কথা জানা যায়। সারা বিশ্বে অদ্যাবধি প্রায় ১৯০,০৪০ টন স্বর্ণ সাগর থেকে উত্তোলিত হয়েছে।

শ্রী কল্যাণ মিত্র রচিত ‘সাগর সেচা মানিক’ নামে নাটকের একটি বই আছে। সাহিত্য বলে কথা! সাগরজলকে সিঞ্চন করে কোনোভাবেই মানিক বা মুক্তা পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা মুক্তা থাকে ঝিনুকের খোলসের মধ্যে। Pinctada গণের (Genus) দুটি প্রজাতির ঝিনুকের দেহের মধ্যে কয়েক বছর ধরে প্রাকৃতিক নিয়মে মুক্তা তৈরি হয়।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মুক্তা আহরণ করতে হলে ওই বিশেষ প্রজাতির ঝিনুকের চাষ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমেই মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব। তবে সাগরে এমন প্রাণীও রয়েছে যারা সরাসরি সাগরজল থেকে সংগৃহীত খনিজ উপাদান তাদের দেহে জমা করে রাখতে সক্ষম, যেমন- Sea Cucumber ও Ascidian-এর রক্তে Vanadium আবিষ্কৃত হয়; Copper আবিষ্কৃত হয় Lobster-এর রক্তে; Cobalt ও ঘরপশবষ কিছু ঝিনুক ও শামুকের দেহে সংগৃহীত হয়।

বাংলাদেশের সমুদ্র বিজ্ঞানীরাও হয়তো ভবিষ্যতে এসব প্রাণীর সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে তাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারবেন সাগরের দুর্লভ রত্নাবলী। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ও ২৫ প্রজাতির চিংড়ি ছাড়াও রয়েছে কাঁকড়া, ঝিনুক, লবস্টার, অক্টোপাস, তারা মাছ, কচ্ছপ, জেলি মাছ, সাগর শসা, কস্তুরা, সাগর কুসুম, হাঙ্গর, তিমি ইত্যাদি এবং সামুদ্রিক উদ্ভিদের বিশাল মজুদ। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশে সরকারিভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সামুদ্রিক মৎস্য ও চিংড়ি আহরণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

বর্তমানে শুধু বেসরকারি পর্যায়ে এ আহরণের কাজ চলছে। এটা সত্য, মাছ ও চিংড়ি ছাড়া উল্লিখিত অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের চাহিদা আমাদের দেশে তেমন নেই। কিন্তু বহির্বিশ্বে এ প্রাণী ও উদ্ভিদের বেশ চাহিদা রয়েছে বিধায় এগুলো আহরণ করে বিদেশে রফতানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করার বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনার দাবি রাখে।

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের রয়েছে মহীসোপান এবং একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল। পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুময় সমুদ্রসৈকত রয়েছে কক্সবাজার এলাকায়। সৈকতের বালিতে সাধারণত সিলিকোন, জিরকন ইত্যাদি খনিজপদার্থ বিদ্যমান থাকে।

প্রকৃতির এমন আশীর্বাদপুষ্ট হয়েও দেশের অপার সম্ভাবনাময় সমুদ্রসম্পদের আহরণ ও ব্যবহার থেকে আমরা কতকাল বিরত থাকব? শেক্সপিয়ার যথার্থই বলেছেন- ‘A sea changes into something rich and strange’.

মুহাম্মদ আলী আজম খান : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মেরিন ফিশারিজ ইউনিট, চট্টগ্রাম; সাবেক প্রিন্সিপাল, মেরিন ফিশারিজ একাডেমি, চট্টগ্রাম

সুত্র: যুগান্তর

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , ,

oceantimesbd.com