ডলফিন কেন পানিতে বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করে

ডলফিন শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে পানিতে দাপাদাপি করে সাঁতরে বেড়ানো এক উচ্ছল প্রাণীর ছবি। তা ছাড়া পানি থেকে লাফিয়ে বল নিয়ে খেলা করা, মানুষকে আলিঙ্গন করাসহ ডলফিনের বিচিত্র সব কর্মাকাণ্ড হরহামেশা দেখি আমরা। ডলফিনের এমন সাবলীল আচরণের মূল কারণ তো আপনি জানেনই। জলচর প্রাণীদের মধ্যে ওরা দারুণ বন্ধুসুলভ। বুদ্ধিমত্তায় হার মানাবে অনেক প্রাণীকে। সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশতে এদের জুড়ি মেলা ভার।

অনেকে ডলফিনকে মানুষের পর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী বলে মনে করেন। এই ধারণা কিন্তু গবেষণাসাপেক্ষ। তবে বুদ্ধির বিচারে প্রাণীদের মধ্যে ডলফিনকে প্রথম সারিতেই রাখা হয়। বুদ্ধি না থাকলে কি আর মানুষের বন্ধু হওয়া যায়! ডলফিন মানুষের সঙ্গে যে অকৃত্রিম বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তার বড় প্রমাণ পানিতে পড়া বিপদগ্রস্ত মানুষমাত্রই জানে। এমন বহু ঘটনা আছে, যেখানে পানিতে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছে ডলফিন।

সামুদ্রিক প্রাণী হলেও সমুদ্র উপকূলবর্তী নদীগুলোতেও বিচরণ করে ডলফিন। সাধারণত মানুষের আশপাশে থাকতে পছন্দ করে এরা। এ কারণে লোকালয়ের আশপাশের কোনো নদী বা সমুদ্রে ওদের প্রায়ই দেখা যায়। তাই সমুদ্রে পথহারা কোনো নাবিক যদি ডলফিনের ঝাঁক দেখতে পান, তাহলে তিনি ধরে নিতে পারেন, আশপাশেই হয়তো উপকূল আছে। তার মানে বিপদ থেকে বেঁচে ফেরার আশা আছে। ডলফিন যে কত মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে, তার কোনো লেখাজোখা নেই। প্রতিটি ঘটনাই চমকপ্রদ।

১৯৯৬ সালের কথা। মার্টিন রিচার্ডসন নামের এক ব্রিটিশ ডুবুরি মিসরের সিনাই উপদ্বীপে লোহিত সাগরে সাঁতার কাটছিলেন। এক হাঙর তাঁকে আক্রমণ করে। কিছুটা দূরে থাকা বাকি ডুবুরি বন্ধুরা দেখতে পান, তিনটি বোতলমুখো ডলফিন রিচার্ডসনের চারদিকে ঘুরছে। কেবল ঘুরছে যে, তা নয়, পাখনা ও লেজ ঝাপটে ওরা হাঙরটাকে ভয়ও দেখাচ্ছিল। ডলফিনগুলোর কারণেই সে যাত্রা বেঁচে যান রিচার্ডসন।

ইতালির পূর্ব উপকূলের অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর তার বাবার সঙ্গে নৌকায় ছিল। কিন্তু ছেলে যে কখন নৌকা থেকে পড়ে গেছে, তা বাবা বুঝতেই পারেননি। ছেলেটি সাঁতার জানত না। যার অর্থ দাঁড়ায়, অল্প সময়ের মধ্যেই ডুবে মৃত্যু অনিবার্য ছিল তার। কিন্তু সে সময় এক ডলফিন এসে ছেলেটিকে তার মাথা দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল, যাতে সে ডুবে না যায়। বিষয়টি বুঝতে পেরে ছেলেটি ডলফিনকে জড়িয়ে ধরে এবং বন্ধু ডলফিন তাকে নৌকার কাছে নিয়ে যায়। এতটাই কাছে নিয়ে যায় যে বাবা খুব সহজেই ছেলেকে কোলে তুলে নিতে পেরেছিলেন। ২০০০ সালের ওই ঘটনার পর থেকে ফিলিপ্পো নামের ডলফিনটি ওই এলাকায় সবার প্রিয় বন্ধু হয়ে যায়।

২০০৪ সালে নিউজিল্যান্ডে সাঁতার কাটতে নামেন চারজন। কিছুক্ষণ পর তাঁরা লক্ষ করেন, চারপাশে একঝাঁক ডলফিন ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথমে সবাই ভাবেন, স্তন্যপায়ী এই প্রাণীগুলো হয়তো খেলার ছলে এ রকম করছে৷ কিন্তু সবাই যখন আসল ব্যাপারটা ধরতে পারলেন, তখন ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম। খুব কাছেই বিশাল আকৃতির এক সাদা হাঙর ছিল। ডলফিনের দল প্রায় ৪০ মিনিট ধরে এভাবে ঘুরতে থাকে। ততক্ষণে হাঙর নিরাশ হয়ে চলে যায়। বড় ধরনের বিপদের হাত থেকে বেঁচে যান চারজন।

২০০৭ সালেও অনেকটা একই রকম ঘটনা ঘটে। তবে সেবার টড এনড্রিস নামের এক সার্ফার হাঙরের আক্রমণ থেকে রেহাই পান না। এনড্রিসের ঘাড়ে ও পায়ে কামড় বসায় হাঙর। তবে এবারও উদ্ধারকারী হিসেবে এগিয়ে যায় একঝাঁক ডলফিন। সেবার মৃত্যুর একদম কাছ থেকে নতুন প্রাণ নিয়ে ফিরে আসেন এনড্রিস। সেদিন ডলফিনগুলো এনড্রিসের পাশেই ছিল, যতক্ষণ না তিনি উপকূলে পৌঁছান।

একটু ঘেঁটে দেখলে এ রকম আরও অনেক ঘটনা পাওয়া যাবে, যেখানে ডলফিন হয় মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে, নয়তো বড় ধরনের বিপদ থেকে মুক্ত করেছে। ডলফিন কেন মানুষকে বিপদে সাহায্য করে, বিষয়টি বুঝতে বিজ্ঞানীরা নিয়মিত গবেষণা করে যাচ্ছেন। শতভাগ নিশ্চিত হয়ে এর উত্তর হয়তো এখনো বলার সময় আসেনি। তবে ডলফিনের বুদ্ধিমত্তা একটি বড় কারণ। প্রায় মানুষের সমান মগজ আছে এই প্রাণীর৷ এ কারণেই এরা বেশ বুদ্ধিমান। তা ছাড়া যথেষ্ট সামাজিকও এরা। এ কারণেই ওরা নিয়মিত দল বেঁধে জীবন কাটায়, কিংবা বলা যায় জীবনযাপন করে। এখানেই ওদের সঙ্গে মানুষের বড় মিল।

বিজ্ঞানীরা আরও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, ডলফিন আয়নায় নিজেদের চিনতে পারে, যা প্রাথমিকভাবে প্রমাণ করে, এরা আত্মসচেতন। এই ক্ষমতা উচ্চতর সহানুভূতির এবং পরোপকারী আচরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের বালটিমোরে অবস্থিত জাতীয় অ্যাকুয়ারিয়ামের গবেষকেরা। মানুষকে সাহায্য করার কারণ হিসেবে এটি একটি বড় যুক্তি হতেই পারে। তবে আরও খতিয়ে দেখছেন বিজ্ঞানীরা। কিছু কিছু বিজ্ঞানী তো প্রশ্ন রেখেছেন, ডলফিনের এই আচরণ কি জৈবিকভাবে প্রোগ্রাম করা প্রতিক্রিয়ামাত্র?

গত ৯ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ভেসে আসে ৬ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি মৃত ডলফিন গত ৯ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ভেসে আসে ৬ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি মৃত ডলফিনছবি: সংগৃহীত
ডলফিন যে আমাদের বন্ধু, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষ কি বন্ধুর মতো আচরণ করছে? ২০২১ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত পটুয়াখালীর বিভিন্ন সমুদ্রসৈকতে ২০টির বেশি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছে, যা বেশ উদ্বেগ জাগানিয়া।

ডলফিনের মৃত্যুর উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ অ্যাকটিভিটির গবেষণা সহযোগী সাগরিকা স্মৃতি মনে করেন, যত্রতত্র জাল ফেলে মাছ শিকার করার কারণে ডলফিন যেমন ধরা পড়ছে, পাশাপাশি আঘাতপ্রাপ্তও হচ্ছে। তা ছাড়া সুন্দরবনের কিছু অসাধু জেলে বিষ দিয়ে মাছ মারেন। এতে ডলফিনও মারা পড়ে। অন্যদিকে জেলেদের ফেলা নানান ধরনের ছেঁড়া জাল, মানুষের ফেলা আবর্জনা, বিশেষ করে পলিথিনের কারণে ডলফিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ডলফিন তো আর প্রশ্ন করতে পারছে না। যদি করতে পারত, তাহলে প্রশ্নটি এ রকম হতো—যে ডলফিন তার পাখনা ঝাপটে, লেজ নেড়ে মানুষকে বাঁচিয়েছে, তার প্রতি কি মানুষ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে না?

সূত্র: ডলফিন ওয়ে ডটকম ও রিয়্যাল ক্লিয়ার সায়েন্স ডটকম

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

oceantimesbd.com