“জানা অজানায় ঘেরা বৃহত্তম প্রশান্ত মহাসাগর”

বিশাল পৃথিবীকে সবদিক দিয়ে ঘিরে আছে পৃথিবীর বৃহত্তম মহাসাগর প্রশান্ত মহাসাগর। এ মহাসাগরের প্রতি কোণায় কোণায় রহস্যে ভরপুর। ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ নাবিক তথ্য অনুসন্ধানকারী ফার্ডিনান্ড ম্যাগেলান নৌকাযোগে সমুদ্রে বহু প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করে এই মহাসাগরে এসে সামান্য প্রশান্তি পান।তাই তিনি এই জলভাগের নাম রাখেন মার প্যাসিফিকো, যার অর্থ পর্তুগিজ এবং স্প্যানিশ উভয় ভাষাতেই ‘প্রশান্ত মহাসাগর’।

প্রশান্ত মহাসাগর আয়তনে পৃথিবীর মোট স্থলভাগের চেয়েও বড়। আয়তনে ১৬,৫২,৫০,০০০ বর্গকিলোমিটার (৬,৩৮,০০,০০০বর্গমাইল) অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত প্রশান্ত মহাসাগর বিশ্ব মহাসাগরের উপকেন্দ্র গুলির মধ্যে সর্বাধিক। তাছাড়াও এটি পৃথিবীর মোট জলভাগের উপপরিতলের ৪৬ শতাংশ জুড়ে অবস্থিত।

প্রশান্ত মহাসাগর উত্তরে উত্তর মহাসাগর থেকে দক্ষিণ মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যদিকে এর পশ্চিমে রয়েছে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া এবং পূর্ব সীমান্তে রয়েছে উত্তর আমেরিকা। এ মহাসাগরের বিস্তৃতি বিশাল।এক কথায় বলতে গেলে এত বড় মহাসাগরের মধ্যে পাঁচটি চাঁদকে অনায়াসে ডুবিয়ে দেওয়া যাবে। এ মহাসাগরের সবমিলিয়ে থাকা পানির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৭১ কোটি ঘনকিলোমিটার বা ১৭ কোটি ঘনমাইল।

এ মহাসাগরের পানির তাপমাত্রা মেরুর কাছে -১.৪ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে শুরু করে বিষুবীয় এলাকায় সর্বোচ্চ ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। তাপমাত্রার মতো এ সাগরের পানির গুনাগুন বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।

প্রশান্ত মহাসাগরের গড় গভীরতা প্রায় ৪ কিলোমিটার বা ৪২৮০মিটার। তবে পৃথিবীর গভীরতম বিন্দুর ৫টি বিন্দুই প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। এ তালিকার প্রথমেই রয়েছে পৃথিবীর গভীরতম বিন্দু যা মারিয়ানা ট্রেঞ্চে অবস্থিত। চ্যালেঞ্জার ডিপ নামক এই বিন্দুটির গভীরতা ১১ হাজার মিটারের বেশি। তালিকার বাকি ট্রেঞ্চ গুলি হল যথাক্রমে টুঙ্গা ট্রেঞ্চ, কুরিল কানচাতকা ট্রেঞ্চ, ফিলিপাইন ট্রেঞ্চ এবং কারমাডিজ ট্রেঞ্চ।
অন্যদিকে এত বড় মহাসাগর কি ঘিরে রয়েছে প্রায় অর্ধশত স্বাধীন দেশ। স্বাধীন দেশ ছাড়াও এতে রয়েছে প্রায় ২৫,০০০ দ্বীপপুঞ্জ।

এ সকল দ্বীপপুঞ্জকে তিনটি মূলধারায় ভাগ করা যায়।আর এগুলি হল:- মাইক্রোশিয়া,মেলানেশিয়া এবং পলিনেশিয়া। উত্তর-পশ্চিম দিকে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ,মধ্যভাগে ক্যারোলিন দ্বীপপুঞ্জ, পূর্ব দিকে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কিরিবাতি রাষ্ট্রের অনেকগুলো দ্বীপ মিলে গঠিত হয় এই মাইক্রোনেশিয়া। মূলত নিরক্ষরেখার উত্তর দিকে ও আন্তর্জাতিক তারিখ রেখার পশ্চিম দিকে অবস্থিত দ্বীপগুলি হল মাইক্রোনেশিয়া।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ ‘নিউগিনি’-ও এ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত। আবার অন্যদিকে সর্বাধিক প্রসারিত পলিনেশিয়া উত্তরে হাওয়াই থেকে দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত।

প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলো চার ধরনের।আর এইগুলি হলো – মহাদেশীয় দ্বীপ,উচ্চ দ্বীপ, প্রবাল প্রাচীর এবং উদ্ধৃত প্রবালভূমি।এদের মধ্যে মহাদেশীয় দ্বীপ গুলির বেশিরভাগই নিকটবর্তী মূল ভূ-ভাগের মতোই ভূমিরূপ বিশিষ্ট। অন্যদিকে এ মহাসাগরের উচ্চ দ্বীপগুলি হল আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত।

এ মহাসাগরের নিচে একটি অঞ্চল আছে যাতে প্রায় ৪৫২টি আগ্নেয়গিরি আছে। এ ভয়ানক অঞ্চলকে বলা হয় “রিং অফ ফায়ার”। তাই যেকোনো সময়ই আগ্নেয়গিরির অগ্নিউৎপাতে পানির নিচে সৃষ্টি হয় প্রবল ভূমিকম্প।আর তাই সমুদ্রের পানিতে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড ঢেউ। এ রকম দ্বীপগুলো হলো বুগেনভিল,হাওয়াই এবং সলোমন দ্বীপপুঞ্জ। আবার প্রবাল প্রাচীরের মধ্যে সর্বাধিক নাটকীয় হলো অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর অবস্থিত গ্রেট বেরিয়ার রিফের প্রবাল প্রাচীরের সারি।

বিস্ময়ের শেষ নেই এই মহাসাগরে। এ মহাসাগরের এক অপার প্রাকৃতিক বিস্ময় হল অনেক জায়গায় একই সাথে দুই রঙের পানির উপস্থিতি। যেন কেউ দাগ কেটে একই সাগরে দুই পাশে দুই রঙের অংশ আলাদা করে দিয়েছে ।এর একদিকে হালকা আকাশি রংয়ের পানি আর অন্য দিকের পানি গাঢ় নীল।

তাছাড়াও এখানে রয়েছে ‘ডেভিলস সি’। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে একটি উপসাগরের নাম ‘ডেভিলস সি’। আবার জাপানি উপকূলের কাছে অবস্থিত এ মহাসাগরের একটি অংশের নাম ‘ড্রাগন ট্রায়াংগল’। এখানে বহু জাহাজ ও বিমান হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও আজ পর্যন্ত তাদের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। অবাক করা ব্যাপার হলো এর রহস্য আজ পর্যন্ত অজানা।

তাছাড়াও এ মহাসাগরে এমন অনেক দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে যা এই বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশের ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদখানা।
এই বিস্ময়কর মহাসাগরে বিস্ময়ের অন্ত নেই। এই সাগরের অতলে রয়েছে জানা-অজানা অনেক প্রাণী। বিশালাকার তিমি থেকে শুরু করে রয়েছে হাঙ্গর, অক্টোপাস,স্কুইড,ডলফিন, শুশুকসহ নাম না জানা অনেক প্রাণী।

এ মহাসাগরকে ঘিরে রহস্যের শেষ নেই।যত রহস্যই আবিষ্কার হোক না কেন তাও এর আরো অনেক রহস্য থেকে যায় অজানা। প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য এ মহাসাগর হল অজানাকে জানার এক বিপুল ভান্ডার।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: ,

oceantimesbd.com