সমুদ্রের ‘পানি পরিষ্কারক’ হিসেবে ভুমিকা রাখে শামুক-ঝিনুক

একটি ঝিনুক প্রতিদিন গড়ে ২৪-৯৫ গ্যালন পানি পরিশুদ্ধ করে। দেশে ১৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক ঝিনুক ও ১৫৯ প্রজাতির শামুক রয়েছে। কক্সবাজার সৈকত থেকে ঝিনুকের প্রায় আশি শতাংশ আবাসস্থলই হারিয়ে গেছে।

কালের বিবর্তনে দেশের উপকূল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ‘ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার্স’ বা বাস্তুসংস্থান প্রকৌশলী হিসেবে পরিচিত সামুদ্রিক শামুক-ঝিনুক। গত তিন দশকে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সৈকত থেকে ঝিনুকের প্রায় আশি শতাংশ আবাসস্থলই হারিয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এ পরিস্থিতির জন্য পরিবেশ দুষণ, আবাসস্থলের পরিবর্তন, নির্বিচারে ঝিনুক আহরণসহ নানা কারণকে দায়ী করা হচ্ছে।

সমুদ্রের ‘পানি পরিষ্কারক’, ‘সৈকতের পাহারাদার’সহ নানা নামে পরিচিত ঝিনুককে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য বা প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য অপরিহার্য অঙ্গ বলে বিবেচনা করা হয়। ঝিনুক হারিয়ে গেলে সমুদ্রের অসংখ্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে আশংকা করেন বিজ্ঞানীরা। কারণ একটি ঝিনুক প্রতিদিন গড়ে ২৪ থেকে ৯৫ গ্যালন পানি পরিশুদ্ধ করে বলে অভিমত বিজ্ঞানীদের।

দেশ থেকে সামুদ্রিক ঝিনুক হারিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে কক্সবাজারস্থ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিউিটের (বিএফআরআই) সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আলী বলেন, কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর মোহনা থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সামুদ্রিক উপকুলে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ঝিনুকের আবাসস্থল রয়েছে। এসব অঞ্চলের ঝিনুকে মুক্তাও পাওয়া যায়। প্রায় এক যুগ আগের এক জরীপে দেশে ১৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক ঝিনুক ও ১৫৯ প্রজাতির শামুক শনাক্ত হয়। যার মধ্যে প্রায় ৩০ প্রজাতির সামুদ্রিক ঝিনুক থেকে মুক্তা পাওয়া যায়। আর এরমধ্যে ৩টি সামুদ্রিক প্রজাতির ঝিনুক বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে ঝিনুক থেকে মুক্তা উৎপাদনও করা সম্ভব।

পরিবেশবিদদের মতে, সাম্প্রতিককালে নির্বিচারে ঝিনুক আহরণ, পরিবেশ দুষণ ও আবাসস্থলের পরিবর্তনসহ নানা কারণে দেশ থেকে ঝিনুকের আবাসস্থল হারিয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশে ঝিনুকের গুরুত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলেন, একটি ঝিনুক প্রতিদিন গড়ে ২৪-৯৫ গ্যালনের ওপরে পানি পরিশুদ্ধ করে। পানির নাইট্রেটস ও অ্যামোনিয়া শোষন করে পানিকে বিভিন্ন প্রাণির বসবাসের উপযোগী রাখে। ঝিনুক তাদের অভ্যাসগত কার্যক্রমের মাধ্যমে এমনভাবে কাঠামো তৈরি করে যাতে সমুদ্র উপকূলে জোয়ার প্রবাহ, তরঙ্গ ক্রিয়া এবং পলল গতিবেগ প্রভাবিত হয়। সামুদ্রিক প্রবাহ থেকে মাটি ক্ষয় রোধ করে সমুদ্রের তীর গঠনে খুব গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে ঝিনুক। এ কারণে উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের জন্য ঝিনুকের ভূমিকা অপরিহার্য। ঝিনুক না থাকলে সমুদ্রের অনেক প্রাণি টিকে থাকতে পারতো না।

ড. জুলফিকার আলী বলেন, ঝিনুক থেকে অলংকার ও গৃহ সাজসজ্জাকরণ উপকরণ ছাড়াও ঝিনুকের খোলস থেকে চুন, পোল্ট্রি ও ফিশ ফিড তৈরি হয়। মাছ ও প্রাণির ক্যালসিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ঝিনুক। এছাড়া ঝিনুকের মাংসল অংশ চিংড়ি, মাছ ও হাঁস-মুরগীর খাবার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো ঝিনুকের মাংস খেয়ে থাকে।

তবে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ঝিনুক সংগ্রহের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ায় দেশ থেকে ঝিনুক হারিয়ে যাচ্ছে বলে জানান কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা।

তারা জানান, ঝিনুকের আবাসস্থল হারিয়ে যাওয়ার কারণে জোয়ারের প্রবাহে সমুদ্র উপকূলের মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে মুক্তার প্রাপ্যতাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিশ্বের প্রায় স্বল্প উষ্ণপ্রধান ও উষ্ণপ্রধান সামুদ্রিক জলাশয় ঝিনুকের আবাসস্থল। এরা সমুদ্রের স্বল্প গভীর হতে ৮০ মিটার গভীর এলাকায় বিচরণ করে। মানুষ ও জলজ পরিবেশ উভয়ের জন্যই ঝিনুক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জলাশয় থেকে শৈবাল, জৈব পদার্থ এবং দ্রবীভুত ক্ষতিকারক উপাদান যেমন: ভারী ধাতু দুরীকরণে ঝিনুকের ভূমিকা রয়েছে। তাই ঝিনুক প্রাকৃতিক পানি পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। জলজ খাদ্য শৃঙ্খলের ক্ষেত্রেও ঝিনুক একটি গুরুত্বপুর্ণ উপাদান এবং এরা জলজ খাদ্য শিকলের বিভিন্ন স্তরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করলে পরিবেশের ক্ষতি হয়।

স্থানীয়রা জানান, এক সময় শহরের লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতে প্রচুর পরিমাণ ঝিনুক দেখা যেতো। কিন্তু শহরে এখন ঝিনুকের আবাসস্থল নেই বললেই চলে। একইভাবে কলাতলী থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন পর্যন্ত সৈকতেও আগের তুলনায় খুব কমই ঝিনুক পাওয়া যাচ্ছে। এখন সৈকতে মরা ঝিনুক পাওয়া না যাওয়ায় অনেকেই পানি ও মাটির নীচ থেকে জীবন্ত ঝিনুক তুলে এনে বিক্রি করছে। কক্সবাজারের বাঁকখালী ও সোনাদিয়া মোহনা, হিমছড়ি, পেঁচারদ্বীপ, ইনানী, মনখালী, শাপলাপুর, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন উপকূল থেকে অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে শামুক-ঝিনুক।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

oceantimesbd.com