সমুদ্রের গভীরতম মাছ স্নেইলফিশের যত অজানা তথ্য

গত সপ্তাহে, বিজ্ঞানীরা ৮ কিমি (২৭,০০০ ফুট) গভীরে একটি মাছের সাঁতারের চিত্রগ্রহণ করেছেন, যা মানুষের দ্বারা নথিভুক্ত করা সবচেয়ে গভীরতম মাছের জন্য একটি নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে।

জাপানের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ইজু-ওগাসাওয়ারা নামক ট্রেঞ্চের ৮,৩৩৬ মিটার (২৭,৩৪৯ ফুট) গভীরতায় Pseudoliparis প্রজাতির অজানা ধরণের স্নেইলফিশের সাঁতার ক্যামেরায় ক্যাপচার করা হয়েছে।এটি ২০১৭ সালে এক গবেষক দলের দ্বারা করা আগের রেকর্ডিংয়ের চেয়ে ১৫৮ মিটার গভীর এবং সমস্ত মাছের জন্য গভীরতার সীমার কাছাকাছি।

এর আগে রেকর্ড করা গভীরতম মাছ ছিল মারিয়ানা স্নেইলফিশ (Pseudoliparis swirei), যা মারিয়ানা ট্রেঞ্চে জাপান এবং পাপুয়া নিউ গিনির আরও দক্ষিণে ৮,১৭৮ মিটার (২৬,৮৩১ ফুট) গভীরতায় রেকর্ড করা হয়েছিল।

সমুদ্রের গভীরতম অংশগুলি Hadal zone নামে পরিচিত, যার নামকরণ করা হয়েছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্রীক দেবতা হেডিসের নামে। Hadal zone , যা ৬ থেকে ১১ কিমি (২০,০০০ থেকে ৩৬,০০০ ফুট) পর্যন্ত বিস্তৃত,যেখানে চাপ ৬০০ atm এর বেশি,জল খুব ঠান্ডা, ১.৩ থেকে ৩ºC,আলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, তাই অন্ধকার চরম,কোন সিজনাল ভ্যারিয়েশন দেখা যায় না,প্রাণী অন্ধ বা অকেজো চোখ আছে,উপরের স্তর থেকে প্রাপ্ত খাদ্য খেয়ে থাকে,প্রধানত ডেট্রিটাস।

যেহেতু বিজ্ঞানীরা প্রথম ১৮০০ এর দশকে গভীর সমুদ্র অধ্যয়ন করতে আগ্রহী হয়েছিলেন, তাই সেখানে বসবাসকারী প্রজাতিগুলি বোঝার জন্য প্রচুর গবেষণা পরিচালিত হয়েছে।যেহেতু এই গভীরতায় কাজ করা অত্যন্ত কঠিন, সেখানে প্রাপ্ত জীবনের বেশিরভাগ অংশ বিজ্ঞানের কাছে অজানা থেকে যায়।দীর্ঘকাল ধরে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেছিলেন যে এই প্রতিকূল অবস্থার কারণে সমুদ্রের গভীরতায় জীবন অসম্ভব, কিন্তু সেই ধারণাটি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয় ১৯৭৭ সালে, যখন একটি মার্কিন গবেষণা দল দূরবর্তীভাবে চালিত একটি যান ৮,০০০ ফুট (২,৪৪০ মিটার) প্রশান্ত মহাসাগরে প্রেয়ন করে যা হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের ছবি ধারণ করেছিল যেখানে সমুদ্রের জল ম্যাগমার সাথে মিলিত হয়। তারা এই গভীর সমুদ্রের অজানা প্রজাতি দেখতে পাই।

১৯৭৭ সাল থেকে, সামুদ্রিক বিজ্ঞানীরা ৬০০টি পর্যন্ত আগে কখনও দেখা যায়নি এমন প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে scaly-foot gastropod, (Chrysomallon squamiferum), লোহার বর্মযুক্ত এক ধরনের শামুক এবং ‘The Hoff’ নামে একটি নতুন কাঁকড়া (Kiwa tyleri)।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সমুদ্র অন্বেষণের গতি যেমন বেড়েছে, এমনকি গভীরতর মাছও পাওয়া যেতে পারে। সমুদ্রের গভীরতম অংশ, মারিয়ানা ট্রেঞ্চে প্রথম মানুষবাহী ডাইভের সময়, ক্রুরা ১০,০০০ মিটারেরও বেশি গভীরে ফ্ল্যাটফিশ হিসাবে ব্যাখ্যা করা দেখে রিপোর্ট করেছিল।

সম্প্রিতি ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এবং টোকিও ইউনিভার্সিটি অফ মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা গত রবিবার স্নেইলফিশটির ফুটেজ প্রকাশ করেছেন, যা গত সেপ্টেম্বর মাসে জাপানের গভীর সামুদ্রিক ট্রেঞ্চে সি রোবটের মাধ্যমে ধারণ করা হয়েছিল।স্নেইলফিশ হল এমন একটি মাছের পরিবার যা ঠাণ্ডা এবং গভীর জলের মতো অনাগত আবাসস্থলগুলিকে কাজে লাগাতে সফল হয়েছে, যার ফলে তারা দ্রুত বহু প্রজাতিতে বিবর্তিত হতে পারে৷

এই অভিযানের নেতৃত্বদানকারী মিন্ডারু-ইউডাব্লিউএ ডিপ সি রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী অ্যালান জেমিসন বলেন, “এই আবিষ্কারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একটি নির্দিষ্ট ধরণের মাছ কতদূর গভীরতায় নামতে সক্ষম সেটি আমাদেরকে দেখায়।”

জেমিসন মাছটিকে একটি কিশোরবয়সী মাছ হিসেবে শ্রেণিকরণ করেন এবং জানান যে, ছোট গভীর সামুদ্রিক স্নেইলফিশগুলো প্রায়ই অগভীর অঞ্চলে সাঁতার কাটা বড় শিকারীদের এড়াতে যতটা সম্ভব গভীরে থাকার চেষ্টা করে।

একই ট্রেঞ্চে ৭,৫০০ থেকে ৮,২০০ মিটার গভীরতায় শট করা আরেকটি ফুটেজে একদল মাছ এবং ক্রাস্টাশিয়ানকে সামুদ্রিক রোবটের সাথে বাঁধা টোপের পেছনে ঘুরতে দেখা যায়।

কীভাবে সমুদ্রের গভীরতম অংশের চরম পরিবেশে এই মাছগুলো বেঁচে থাকে, তা জানা যাবে বন্দী দুটি মাছের ওপর গবেষণা চালিয়ে। মাছগুলোর ছোট চোখ, স্বচ্ছ শরীর এবং অন্য মাছকে ভাসতে সহায়তা করা সুইম ব্লাডার না থাকায় এগুলো সমুদ্রের গভীরতম অঞ্চলে টিকে থাকতে পারে।

জেমিসন জানান প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ দক্ষিণ স্রোত সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর আরও গভীরে যাওয়ার জন্য উপযোগী। আর এখানে সামুদ্রিক প্রাণীর অবাধ বিচরণ থাকায় সমুদ্রের তলদেশে মাছের অবশিষ্ট জমা হয়, যার ফলে সমুদ্রের গভীরে খাবারের অভাব থাকে না।

বিজ্ঞানীরা চরম গভীরতায় বসবাসকারী এই প্রাণীগুলো সম্পর্কে আরও বেশি জানতে চান, তবে এর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো পর্যাপ্ত অর্থ। জেমিসন জানান, প্রতিটি ল্যান্ডার রোবট অ্যাসেম্বল এবং অপারেট করতেই ২ লক্ষ মার্কিন ডলার খরচ হয়। তিনি বলেন, “মূল চ্যালেঞ্জ হলো যে এই গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ব্যয়বহুল এবং বিজ্ঞানীদের কাছে প্রচুর অর্থ নেই।”

মেরিন সাইন্স ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

oceantimesbd.com