আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের প্রাথমিক ধারণা

আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হল সমুদ্র আইন। সমুদ্রের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে আইনের গুরুত্বও সব সময় বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর মোট আয়তনের একাত্তর ভাগই সমুদ্র এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দুই-তৃতীয়াংশই সম্পন্ন হয় সমুদ্র পথে। গত কয়েক দশকের বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি উৎকর্ষের ফলে মানুষের সামনে সমুদ্র সম্পদ আহরণের বিশাল সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। তাই অনেকেই মনে করেন, ভবিষ্যতের বৈশ্বিক অর্থনীতি হবে ব্লু ইকোনোমি বা সমুদ্র ভিত্তিক অর্থনীতি।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ সমূহ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ, অনেকে আগে থেকেই ব্লু-ইকোনোমি বা সমুদ্র ভিত্তিক অর্থনীতি বা সুনীল অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ব্যবহার করে আসছে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে সমুদ্র-সীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় একলাখ আঠারহাজার তিনশতের বর্গ-কিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকা এখন বাংলাদেশের। বাংলাদেশ ও এখন আগ্রহী হয়ে উঠেছে এই সমুদ্র-অর্থনীতিকে কাজে লাগানোর জন্য।

আজকের এই ভিডিয়োতে আমি আপনাদের সাথে আলোচনা করব আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের প্রাথমিক ধারনা নিয়ে, তো চলুন শুরু করা যাক।

————————————————————————–

বেজ লাইন বা (ভিত্তি রেখা) (Article-5)

উপকূলীয় যে রেখা হতে সমুদ্রের দিকে একটি রাষ্ট্রের সমুদ্র অঞ্চল মাপা হয় তাই ভিত্তি রেখা বা Low water line। সাধারণত ভাটার সময় উপকূলের নিম্নতম জলরেখা কে ভিত্তি রেখা ধরা হয়। এটাকে নরমাল বেজ লাইন বা স্বাভাবিক ভিত্তিরেখা বলে।

আপনারা গ্রাফে দেখতে পাচ্ছেন-

আবার,
সন্নিকটে যদি দ্বীপমালা বা উপকূলীয় রেখা গভীর খাতযুক্ত থাকলে সমুদ্র সীমা পরিমাপের ক্ষেত্রে উপযুক্ত বিন্দুসমূহ সংযোগ করে একাধিক সরল রেখা অংকন করে ভিত্তি রেখা নির্ধারণ করতে হয়। এটাকে বলা হয় straight baseline বা সোজা ভিত্তিরেখা সমূহ। (Art-7)

বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে সরকারীভাবে বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে উপকূলীয় সমুদ্রের ১০ ফ্যাদম বা ৬০ ফুট গভীরতা পর্যন্ত ভিত্তিরেখা হিসাবে গ্রহণ করে।

আপনারা বাংলাদেশের বেজ-লাইনের একটা ম্যাপ দেখতে পাচ্ছেন…


এখানে দেখুন- খাতযুক্ত অংশকে একেটা বেজ-পয়েন্ট বা বিন্দু ধরা হয়েছে এবং এই বিন্দু গুলোর উপর ভিত্তি করে একটা রেখা বা স্ট্রেইট বেজ-লাইন টানা হয়েছে।

ইন্টারনাল ওয়াটার বা ইনল্যান্ড ওয়াটার

এবং এই আঞ্চলিক সমুদ্রের ভিত্তিরেখা বা বেজ-লাইন হতে স্থলভাগ পর্যন্ত যে জলরাশি তা রাষ্ট্রের ইন্টারনাল ওয়াটার বা অভ্যন্তরীণ। [see first photo for reference]

টেরিটোরিয়াল সি বা (আঞ্চলিক সমুদ্র সীমা)

বেজ-লাইন থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকাকে একটি রাষ্ট্রের আঞ্চলিক সমুদ্র বা Territorial sea বলে। এই টেরিটোরিয়াল সির উপর উপকূলবর্তী রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার বিদ্যমান থাকে। এই সার্বভৌমত্ব সমুদ্রের তলদেশ বা সিবেড এবং তারও নিচের অন্ত-ভূমি এবং উপরে বায়ুমণ্ডল বা আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। আরও পরিষ্কার করে বললে, এই টেরিটোরিয়াল সি এলাকার, আকাশ, বাতাস, পানির উপরের বাতাস, পানি, পানির নিচে, সমুদ্রের তলদেশ এবং সমুদ্রের তলদেশের মাটির নিচে পর্যন্ত, লিভিং, নন-লিভিং রিসোর্স, জলজ, প্রাণীজ, খনিজ সম্পদ অর্থাৎ সব কিছুর উপর কোস্টাল স্টেটের সার্বভৌমত্ব বজায় থাকবে।

অর্থাৎ- আঞ্চলিক সমুদ্রের উপরের আকাশসীমা কোস্টাল States এর National Air Space হিসাবে গণ্য হবে এবং অনুমতি ছাড়া অন্য কোন দেশের কোন বিমান এই সীমায় প্রবেশ করতে পারবেনা। এই এলাকায় সমুদ্রের নিচে যদি তেল, গ্যাস বা কোন ধরনের খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়, তার উপর কোস্টাল স্টেটেস্‌ এর সবরিন রাইটস্‌ থাকবে। আবার লিভিং রিসোর্স যেমন- যেকোনো ধরনের মাছ, সামুদ্রিক প্রাণী ইত্যাদির উপর কোস্টাল স্টেস্টস্‌ এর সবরিন রাইটস্‌ থাকবে। অন্যদিকে নন-লিভিং রিসোর্স যেমন- সমুদের পানি, সমুদের স্রোত, পানির উপরের বাতাস ইত্যাদির উপর উপকূলবর্তী রাষ্ট্রের সবরিন অথরিটি থাকবে। অনেকে আবার ভাবতে পারেন এই নন-লিভিং রিসোর্স দিয়ে আবার কি হবে, তাদের জন্য বলছি, রাঙ্গামাটি জেলায় কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে নদীর স্রোত কে কাজে লাগিয়ে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বা কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। অনেকে দেশেই সমুদ্রের উপরের বাতাস থেকে বায়ূ-বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

(Contiguous Zone) বা সংলগ্ন অঞ্চল- ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন বিষয়ক কনভেনশনের ৩৩(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভিত্তিরেখা হতে ২৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একটি রাষ্ট্রের সংলগ্ন অঞ্চল বা কন্টিজিয়াস জোন। coastal states এর আঞ্চলিক সমুদ্রে তার কাস্টমস, ফিসকাল, রাজস্ব, অভিবাসন ও স্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রান্ত আইন-কানুনের লঙ্ঘন রোধ করা এবং তার জন্য শাস্তির বিধান করার অধিকার আছে।

ই.ই.জেড (এস্ক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন) বা (বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল)

territorial sea শেষ প্রান্ত ১২ নটিকাল মাইল থেকে গভীর সমুদ্রের ২০০ নটিকাল মাইল পর্যন্ত। মানে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক এলাকা মোট ১৮৮ নটিকাল মাইল তথা ৩৫০ কিলোমিটার।

United Nations Convention of the Law of the Sea- 1982 এর আর্টিকেল ৫৬ অনুযায়ী এই এলাকার সমুদ্রতলের উপরস্থ জলরাশি, সমুদ্রতল ও অন্তর্ভূমিতে অবস্থিত প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান, সদ্ব্যবহার, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে এবং জল, স্রোত ও বাতাস থেকে শক্তি উৎপাদন করা সহ ঐ অঞ্চলের সকল ধরনের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করবে।

আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইনের এর ৫৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে উপকূলবর্তী সকল রাষ্ট্রই এই কনভেনশনের নিয়মাবলী মেনে, ৮৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী-

তৃতীয় পক্ষের রাষ্ট্র যে কূলবর্তী হোক বা না হোক, কূলবর্তী রাষ্ট্রের ই.ই.জেড এলাকা তাদের বাণিজ্য জাহাজ যাতায়াতের জন্য, বিমান চলাচল, সমুদ্রতলে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সাবমেরিন ক্যাবল ও পাইপলাইন স্থাপন সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক অনুমোদিত আইনসংগত কাজে ব্যাবহার করতে পারবে।

আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইনের ৫৬(১) অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে যে E.E.Z এলাকায় উপকূলবর্তী রাষ্ট্র কৃত্রিম দ্বীপ, স্থাপনা নির্মাণ, সামুদ্রিক গবেষণা কেন্দ্র, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সামদ্রিক পরিবেশ রক্ষণ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদি তৈরি করতে।

আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইনের ৫৫ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে E.E.Z এলাকাকে আঞ্চলিক সমুদ্র তথা territorial sea হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না এবং এ সম্পর্কিত আইন কার্যকর করা যাবে না ।

আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইনের ৬০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উল্লিখিত কূলবর্তী রাষ্ট্র কোন স্থাপনা বিশেষায়িত অর্থনৈতিক এলাকায় তৈরি করতে চাইলে তা অবশ্যই নিকটবর্তী কূলবর্তী রাষ্ট্রদের অগ্রিম ভাবে জানিয়ে রাখতে হবে।

(Continental Shelf) মহী-সোপান

সমুদ্রতীরবর্তী একটি দেশের ভূমির কিছুটা অংশ থাকে সমুদ্রের পানির মধ্যে। এখানে সমুদ্রের সর্বোচ্চ গভীরতা সাধারণত ২০০ মিটারের নিচে থাকে। সমুদ্রের পানির মধ্যে ডুবে থাকা একটি দেশের এই অংশকে বলে মহী-সোপান বা Continental Shelf. মহী-সোপান ঢালু-ভাবে নেমে যায় সমুদ্রের মধ্যে। এই ঢালু অংশকে বলা হয় মহীঢাল বা Continental Slope. মহী-সোপান সৃষ্টি হতে পারে দুই ভাবে। এক, মহীসোপান সৃষ্টি হতে পারে সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কায়। বিশেষ করে ঝড়ের সময় সমুদ্রের ঢেউ ভাঙ্গার যে অংশ এসে আছড়ে পড়ে সেই অংশে। কারন, সমুদ্রের ঢেউয়ের আঘাতে ভাঙ্গার এই অংশ ক্ষয় হয়। এখানে এসে জমতে পারে সমুদ্রের পানি অগভীরভাবে। দুই, মহীসোপান সৃষ্টি হতে পারে নদীবাহিত পলিমাটি সমুদ্রে এসে জমার ফলে। এই মহি সোপান আবার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, আমরা সেদিকে যাচ্ছিনা। আপনারা স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছেন, টেরিটোরিয়াল সি এর পর থেকে শুরু হয়ে ই.ই.জেড এলাকার পানির নিচ দিয়ে হাই সি তে চলেগেছে কন্টিনেন্টাল শেলফ। এই মহিসোপানের তলদেশের সব ধরনের প্রাণীজ ও খনিজ সম্পদের উপরও উপকূলবর্তী রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার থাকে।

(High sea) উন্মুক্ত সমুদ্র – Exclusive Economic Zone এর পর থেকে সাগর এবং উপরের বায়ুমণ্ডল বা আকাশ সীমা সবার জন্য উন্মুক্ত। এই এলাকার সমুদ্র ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার এবং বায়ুমণ্ডল ইন্টারন্যাশনাল এয়া স্পেস নামে পরিচিত। মৎস্য আহরণ, জাহাজ চলাচল, বিমান চলাচল সামুদ্রিক গবেষণা ইত্যাদির জন্য একরাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের প্রতি সহনশীল থাকবে।

আজকের এই ভিড়িয়োতে সমুদ্র আইনের একেবারে বেসিক কনসেপ্ট গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের পরিধি অনেক বিস্তৃত। যাদের এই বিষয়ে আরও জানার আগ্রহ আছে, তারা চাইলে- বাংলার জন্য এডভোকেট আমিনুল ইসলাম এবং ইমতিয়াজ আহমেদের লেখা সমুদ্র আইন এবং ইংরেজির জন্য

ডেনমার্কের ইউনিভার্সিটি অফ কোপেনহেগেন, ফ্যাকাল্টি অফ ল এর প্রফেসর ইউশিফুমি তানাকার লেখা দ্যা ইন্টারন্যাশনাল ল অফ দ্যা সি বই টি পড়ে দেখতে পারেন।

বি. দ্র: লেখাটি অনলাইন থেকে সংগৃহিত

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , ,

oceantimesbd.com