কেফায়েত শাকিল : ১৪ নভেম্বর ২০২২, সোমবার, ৯:৪৭:২৪
সেন্টমার্টিন দ্বীপ বর্তমানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। সমুদ্রের নীল ঢেউ এবং নির্মল বায়ু পেতে পর্যটন মৌসুমে এখানে প্রতিদিন ঘুরতে আসেন প্রায় ৮ হাজার পর্যটক।
২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৯টা। নির্মল বায়ুর সেন্টমার্টিনের চৌরাস্তা এলাকায় একটা উটকো গন্ধ নাকে আসে। গন্ধের উৎস খুঁজতে কিছুটা সামনে গিয়ে দেখা যায়, আগুন জ্বলছে। কাছে গিয়ে জানা যায়, দিনভর সংগৃহীত প্লাস্টিক আবর্জনা পোড়ানো হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদফতরের মানমাত্রায় মানুষের স্বাভাবিক বায়ু সহ্যক্ষমতা ৫০ একিউআই। অথচ এয়ার কোয়ালিটি মিটার চালিয়ে দেখা যায়, তখন সেন্টমার্টিনের ওই এলাকার প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ক্ষতিকর সূক্ষ্ম ধূলিকনা উড়ছিলো ৬০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত।
কেন এভাবে পোড়াতে হচ্ছে প্লাস্টিক? জানতে চাইলে স্থানীয়রা জানান, কোনো বিকল্প নেই তাদের হাতে। তাই ক্ষতি জেনেও প্রতিদিনের সংগৃহীত প্লাস্টিক বর্জ্য এনে পোড়ান এখানে।
আব্দুস সামাদ নামের সৈকতের এক ব্যবসায়ী বলেন, প্লাস্টিক আমাদের খুব ক্ষতি করছে। জমিতে গাছ উঠে না, ডিউবয়েলে পানি তুলতে গেলে প্লাস্টিক উঠে আসে। তাই কোনো পথ না পেয়ে এভাবে প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলি।
হামিদুল নামের আরেকজন বলেন, প্লাস্টিক নিয়ে আমরা খুব কষ্টে আছি। যেখানে যাবেন সেখানেই দেখবেন প্লাস্টিক। ময়লার কারণে আগের মতো ট্যুরিস্টও আসে না। এজন্য প্লাস্টিকের ময়লা কমাতে পুড়িয়ে ফেলি।
কিন্তু বায়ুমান বিজ্ঞানী, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলছেন, এভাবে পুড়িয়ে কখনো প্লাস্টিক শেষ করা সম্ভব নয়। বরং প্লাস্টিক পোড়ানোর মাধ্যমে বায়ুদূষণ হয়, পুড়িয়ে ফেলা প্লাস্টিকের কণা মাটিও দূষিত করে। যা পরে বায়ু ও পানিতে মেশার পাশাপাশি মাটির উর্বরতাও নষ্ট করে। সমুদ্রে গেলে মাছের মাধ্যমে খাদ্য হয়ে আসে মানুষের প্লেটে।
এই বক্তব্যে একমত জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার্নাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল টক্সিকোলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী বলেন, প্লাস্টিক পোড়ানোর মাধ্যমে উচ্চমাত্রার রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে মিশে যায়। এতে এজমা আক্রান্ত রোগীরা মারাত্মক পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। এছাড়া যারা দীর্ঘদিন এই এলাকায় বাস করছেন, তাঁরা ক্যান্সারসহ নানান রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়নে পরিবেশ অধিদফতরের নেওয়া প্রায় ১৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বাজেটের একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে ২০২১ সালের জুনে। যদিও প্রকল্পের সময় শেষে ব্যয় করতে না পারায় প্রায় ৩ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রতিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ শীর্ষক এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো ৪টি। সেগুলো হলো- (১) একমাত্র কোরাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন; (২) জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দ্বীপের জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার এবং ইকো-ট্যুরিজম ব্যবস্থার উন্নয়ন; (৩) সেন্টমার্টিন দ্বীপের কোরাল এবং ফ্লোরা ও ফ’না বিষয়ে গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে উপযুক্ত সংরক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন; (৩) সেন্টমার্টিন দ্বীপের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তোলা এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রমে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্টদের সংগে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা বিনিময়।
কিন্তু প্রকল্প চলাকালে ও প্রকল্প শেষে একাধিকবার এই দ্বীপে সরজমিন পর্যবেক্ষণে গিয়ে দেখা মেলে প্লাস্টিকের জঞ্জাল। গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র, যত্রতত্র পড়ে আছে প্লাস্টিক আবর্জনা। সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসছে প্লাস্টিক, মিঠাপানির রিজার্ভারও প্লাস্টিকে ভরা। পয়ঃনিষ্কাশনের ড্রেন, ম্যানগ্রোভ বন কিংবা হোটেল-রিসোর্টের অলিগলি সবখানেই প্লাস্টিক। যা দেখে সহজে বলা যেতে পারে, এটি কোরাল নয় প্লাস্টিকের দ্বীপ। এতো টাকা ব্যয়ের পরও এই অবস্থা কেন জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ এলকাবাসী আঙ্গুল তোলেন পরিবেশ অধিদফতরের দিকে।
পরিবেশ অধিদফতরের এই প্রকল্পের টাকায় সেন্টমার্টিনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিন্দুমাত্র অবদান রাখেনি বলে অভিযোগ করেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ।
প্রকল্পের টাকা কোথায় ব্যয় হয়েছে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আমি বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি, ২০১৭ সালে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য ১৬ কোটি টাকার প্রকল্প এসেছে। কিন্তু এই প্রকল্পের কিছুই আমি জানি না। আমার জানামতে ১৬ টাকাও কোথাও ব্যয় হয়নি। হলে তো পরিবেশের উন্নতি আপনারাই দেখতেন।
তিনি বলেন, আমরা প্লাস্টিক নিয়ে কতোটা মুশকিলে আছি, আপনারা দেখেছেন। বাধ্য হয়ে এখন কর্মচারি রেখে সব ময়লা কুড়িয়ে এনে পুড়িয়ে ফেলছি। অথচ সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা আমাদের এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসছে না।
ওই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমান অভিযোগ করেন, পরিবেশ অধিদফতর এখানকার প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে কিছুই করেনি। তাদের কোনো কর্মসূচি ওয়ার্ডের কোনো জনগণও দেখেনি বলে দাবি করেন এই তৃণমূল প্রতিনিধি।
তাঁরা (পরিবেশ অধিদফতর) বিমানে চড়ে, দামী দামী গাড়ি হাঁকিয়ে ঢাকা থেকে এসেছেন। দামী হোটেলে থেকেছেন। আমোদ-ফূর্তি করেছেন আর টিএডিএ নিয়েছেন। এভাবেই টাকা নষ্ট হয়েছে। সেন্টমার্টিনের পরিবেশের উন্নয়নে কোনো টাকা ব্যয় হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে বারবার সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা, পরিবেশ আধিদফতরের প্ল্যানিং শাখার পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার-এর কাছে ধর্ণা দিলেও কোনোভাবেই ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি করানো যায়নি তাঁকে। তবে ক্যামেরার বাইরে তিনি দাবি করেন, সেন্টমার্টিনের বর্জ্য পরিষ্কার করা তাঁর প্রকল্পের কাজ ছিলো না।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তোলার কথা থাকলেও সেটি হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো প্রকল্পই শতভাগ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয় না। প্রকল্প প্রণয়নের সময় অনেক কিছুই দেওয়া হয়, যা বাস্তবায়ন করা যায় না। এটা সব প্রকল্পের ক্ষেত্রেই হয়।’
যদিও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, সরকারের প্রকল্পগুলো জনগণের টাকায় পরিচালিত হয়। এসব প্রকল্পে সরকার উদ্দেশ্য দেখেই অর্থ বিনিয়োগ করে। কোনো কর্মকর্তা যদি বলেন যে, সব লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া হয়নি, তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে, প্রকল্পটি নেওয়াই হয়েছে দূর্নীতি বা অবৈধ বাণিজ্য করতে। এ ধরনের প্রকল্পকে অবশ্যই নজরদারি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের টাকা আসে জনগণের পক্ষ থেকে। তাই প্রকল্পের সব বিষয়ে সব সময় প্রকল্প কর্মকর্তারা জনগণের বা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে গণমাধ্যমের কাছে জানাতে বা জবাবদিহি করতে বাধ্য। তা না করলে বুঝতে হবে, এই প্রকল্পে ত্রুটি বা দূর্নীতি রয়েছে।
(বাংলাভিশনে প্রকাশিত)
সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।
Tags: Kafayet shakil, Kafayet Ullah Chowdhury, কেফায়েত শাকিল, টিআইবি, দখল, দূষণ, পরিবেশ অধিদফতর, পর্যটন, প্রকল্প, প্রকল্প বাণিজ্য, সেন্টমার্টিন, সেভ আওয়ার সি
For add