প্রতিটি সিগারেট নষ্ট করে ৩.৭ লিটার পানি

ধূমপান মানব স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকারক সেটি মোটামুটি সবারই জানা। জেনেশুনেই এই ক্ষতিকর উপাদান গ্রহণ করেন ধূমপায়ীরা। ধূমপান শুধু ধূমপায়ীকেই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করে অন্যদেরও। এ কথাও প্রায়ই উঠে আসে বিভিন্ন আলোচনায়। ধূমপান যে পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন তারান্বিত করতেও ভূমিকা রাখে সেটি অনেকটাই আলোচনার বাইরে। এবার জানা গেলো, এক কেজি তামাক পোড়াতে প্রয়োজন ১২ কেজি কাঠ। আর ৩০০ সিগারেটের জন্য কাটা হয় একটি গাছ। আর তামাক চাষের জমিতো আছেই। দেশে শুধু তামাক চাষের জন্যই উজাড় হচ্ছে ৩১ শতাংশ বন।

শুধু তাই নয়, দেশে প্রতি বছর সিগারেটের বাট ও প্যাকেট থেকে ৪০ হাজার ৪৯০ টন বর্জ্য হয়। যা এক দশকেও নষ্ট হয় না। ফলে চরমভাবে পরিবেশ দূষণ হয়। একইসঙ্গে তামাক থেকে বছরে ৮৪ মিলিয়ন কার্বন-ডাই অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে, যা তারান্বিত করে জলবায়ু পরিবর্তন।

এছাড়া সিগারেট ও ই-সিগারেটের বর্জ্য মাটি, পানিকে দূষণ করে সমুদ্রকেও দূষিত করে দিতে পারে। সিগারেটের ফিল্টার ৯৬ ঘণ্টা মিঠাপানিতে থাকলে সেখানকার অর্ধেক মাছকে মেরে ফেলতে পারে। তারচেয়েও বড় তথ্য হলো, একটি সিগারেট উৎপাদনে ব্যয় হয় ৩ দশমিক ৭ লিটার পানি। যা পানির সংকট তৈরিরও অন্যতম কারণ হতে পারে।

রবিবার (১৫ জানুয়ারি) ঢাকা আহছানিয়া মিশনে আয়োজিত ‘পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনায় মূলপ্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সকাল ১০টায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে আহছানিয়া মিশন মিলনায়তনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ঢাকা আহছানিয়া মিশনের সভাপতি কাজী রফিকুল আলমের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা বেগম, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ, মূল প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন ঢাকা আহছানিয়া মিশনের হেলথ এন্ড ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ।

পরিবেশমন্ত্রী বলেন, তামাক উৎপাদক, সেবক, ব্যবসায়ী সবাই স্বীকার করে এটি মানুষ, জীববৈচিত্রের পরিবর্তনে ক্ষতিকর। তারপরও ব্যবসা বন্ধ করা যাচ্ছে না। মানুষের জীবন রক্ষার্থে তামাক বন্ধ করতে হবে। জেনেশুনে বিষপান করেও তামাক ছাড়ছে না বরং মৃত্যুবরণ করছে।

মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে তামাক পান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা চাষিদের তামাক থেকে বের করতে আনতে পারলে সফলতা পাওয়া সম্ভব। স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে তামাক চাষ বন্ধ করা যাবে। প্রধনমন্ত্রীর ২০২৪ সালে তামাকমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব হবে। চাষীদের হয়তো কিছু প্রণোদনা দিতে হবে। এসব জমিতে ধান, গম ও ভুট্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

তিনি বলেন, তামাকের কারণে বৃক্ষ নষ্ট হচ্ছে। তামাক চাষিরা গাছ লাগিয়ে সেই গাছ দিয়েই তামাক পোড়াচ্ছে। অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে গাছকাটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের বনায়ন আছে ১৭ শতাংশ সেটি ২৪ শতাংশে নিতে হবে।

পরিবেশমন্ত্রী বলেন, চলতি বছর থেকেই তামাক চাষ বন্ধে কার্যক্রম শুরু করতে পারি। ২০২৪ সালে গিয়ে পরিপূর্ণভাবে সফল হবো। ইতিমধ্যে পোড়ানো ইট বন্ধে কাজ শুরু হয়েছে। ২০২৫ সালে সরকারি কোন স্থাপনায় পোড়ানো ইট ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কাজী জেবুন্নেসা বেগম বলেন, সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে নিকোটিন টেস্টের আওতায় আনতে হবে।

ড. খলিকুজ্জমান আহমদ বলেন, টেকসই উন্নয়নের তিনটি স্তম্ভ। তামাক জাতীয় ও পারিবারিক অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করে থাকে। ব্যক্তিটি মারা গেলে পারিবারিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতেও ক্ষতির সৃষ্টি করে। সামাজিক ক্ষতি- তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

তামাক কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সে সম্পর্ক বলেন, আগে সিগারেট তিন স্তর ছিল। পরে এটি চার স্তর হয়। আন্দোলনের ফলে এক স্তরে নামিয়ে আনা হয়। বর্তমানে ১ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। ব্রিটিশ ও জাপান টোবাকো অনেক ভ্যাট দেয় বলে সরকার এটি বন্ধ করছেন না। দুটি প্রতিষ্ঠানে সরকারে ১ শতাংশের কম মালিকানা আছে। এটি বাদ দিতে হবে।

প্রবন্ধে বলা হয়, নদী, খাল-বিলে মাছ কম ধরা পড়ছে তার মূল কারণ ৯৬ ঘণ্টা পানিতে সিগারেটের ফিল্টার ভিজিয়ে রাখলে মিঠা পানির অর্ধেক মাছ মরে যায়। তামাক থেকে রাজস্ব আসে বছরে ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা আর স্বাস্থ্যজনিত ক্ষতি হয় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ নীট ক্ষতিই হচ্ছে ৮ হাজার কোটি টাকা।

ইকবাল মাসুদ বলেন, পরিবেশ দূষণে বিশে^র শীর্ষে তামাকের ফিল্টার। বছরে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ব্যবহৃত সিগারেটের ফিল্টার আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেয়া হয়। এগুলো প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে সময় নেয় ১০ বছর। বছরে ৪০ হাজার ৪৯০ টন বাট ও প্যাকেটে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়ে থাকে। তামাকের বর্জ্যদূষণ থেকে বছরে মোট ৮৪ মিলিয়ন কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। পরোক্ষভাবে ৩ কোটি ৮৪ হাজার ধূমপান না করেও ক্ষতির শিকার হয়। বাংলাদেশে ৩১ শতাংশ বন উজাড় হচ্ছে তামাক চাষে। আর তামাকের পাতা শুকাতে বছরে ৮৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। বিশ্বে তামাক চাষ ও পাতা পোড়াতে ২ লাখ হেক্টর বন ধ্বংস হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: ,

oceantimesbd.com