সমুদ্রতলের আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনঃ প্রজেক্ট অ্যাকোয়ারিয়াস টু প্রজেক্ট প্রোটিয়াস

বর্তমানে শুধু মঙ্গল গ্রহেই বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা’র পাঁচটি সক্রিয় মিশন কাজ করছে। সর্বশেষ ইউরোপিয়ান মহাকাশ গবেষণা এজেন্সি’র সংগে নাসা যে ষষ্ঠ মিশন শুরু করতে যাচ্ছে, তা হলো- একটি বেইস স্টেশনের মাধ্যমে চাঁদে ফোর-জি ওয়্যারলেস প্রযুক্তির ওয়াইফাই ব্যবহার। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, আজ পর্যন্ত গ্রহপৃষ্ঠের অবিচ্ছেদ্য ও সবচেয়ে বড় অংশ মহাসাগরের ৮০ ভাগেরও বেশি আমাদের আজানা রয়ে গেছে। মঙ্গলগ্রহ কিংবা চন্দ্রপৃষ্ঠের চকচকে পরিষ্কার সম্পূর্ণ মানচিত্র (complete high resolution map) তৈরি সম্ভব হলেও আজ পর্যন্ত সমুদ্রতলের মাত্র পাঁচ ভাগের স্পষ্ট ম্যাপ তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, অন্য গ্রহ-উপগ্রহের মানচিত্র তৈরিতে আমরা এতো বেশি উদ্যোগী এবং সফল হলেও নিজ গ্রহের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র কেন এখনও তৈরি হয়নি? কারণ, মঙ্গল কিংবা চাঁদের পেছনের হাই রেজোলিউশন ম্যাপ তৈরির অভিযানের চেয়ে সমুদ্র অভিযান অনেক ব্যয়বহুল, কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। মহাকাশে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় মহাকাশ আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র (International Space Station) থাকলেও সমুদ্রের গভীরে গবেষণা স্টেশন তৈরির প্রযুক্তি এখনও পুরোপুরি আয়ত্তে আসেনি। এছাড়া সমুদ্রতলের পরিবেশ-পরিস্থিতি মরুভূমির চেয়ে ভয়ংকর এবং সেখানে বিস্ময়কর প্রাণীদের বিচরণ। তবে, সমুদ্র বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের গুপ্তধনের ভাণ্ডার উম্মুক্ত করার চাবি ইতিমধ্যে প্রায় আয়ত্ত করে ফেলেছেন।

২০১৪ সালে ফ্যাবিয়ান কাস্টউ এবং তাঁর নাবিকদল ‘মিশন ৩১’ নামের অভিযানে সমুদ্রের গভীরে টানা ৩১ দিনের সফল মিশন সম্পন্ন করেছেন। তিনি এবং তাঁর দলের এই অসাধারণ বৈজ্ঞানিক মাইলফলক সফলভাবে সম্পন্ন করতে সমুদ্রচারীরা (Aquanauts) যে ডুবো আবাসস্থল (Underwater Habitat) ব্যবহার করেছেন, এর নাম ছিলো অ্যাকোয়ারিয়াস (Aquarius)। এই অকল্পনীয় মিশনের সবচেয়ে তাক লাগানো অর্জন ছিলো, সমুদ্রের গভীরে ওয়্যারলেস প্রযুক্তির ওয়াইফাই ব্যবহার করে পৃথিবী-পৃষ্ঠের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর সংগে স্কাইপে প্ল্যাটফর্মে লাইভে সমুদ্রের অভ্যন্তরের বিস্ময়কর অভিযান, সমুদ্রের প্রাণিজগতের প্রকৃত চমক এবং তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা শেয়ার করা।

এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার আলোকে ফ্যাবিয়ান কাস্টউ সমুদ্র শিক্ষা কেন্দ্রের (FCOLC- Fabien Cousteau Ocean Learning Center) তৈরি, এর চেয়ে উন্নত ও বড় জলজ ডুবো আবাসস্থল (underwater habitat) গভীর সমুদ্রে নিরবচ্ছিন্নভাবে পরবর্তী প্রজন্মের গবেষণা সুবিধাসহ চূড়ান্ত মিশনে যাত্রা করতে প্রস্ততি নিয়েছে; যার নাম প্রজেক্ট প্রোটিয়াস (Proteus)। এটি এমন এক অত্যাধুনিক গবেষণা প্রকল্প; যার অধীনে সমুদ্রের গভীরে তৈরি হতে যাচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (Underwater International Space Station)।

বিশ্বের বৃহত্তম আন্ডারওয়াটার রিসার্চ স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা

বিশ্বের বৃহত্তম আন্ডারওয়াটার রিসার্চ স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা

ক্যারিবীয় সাগরের ৬০ ফুট গভীরে চার হাজার বর্গফুট বিশিষ্ট বিশ্বের বৃহত্তম আন্ডারওয়াটার রিসার্চ স্টেশন প্রোটিয়াস ল্যাবের ডিজাইন করা হয়েছে; যেখান থেকে ১২ জন গবেষক অনায়াসে সব ধরনের গবেষণা করতে পারবেন এবং পৃথিবীর সংগে যোগাযোগ রাখতে পারবেন। ঠিক যেভাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র (আইএসএস) থেকে নভোচারীরা অত্যাধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে গবেষণা করেছেন এবং পৃথিবীর সংগে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। প্রোটিয়াসে অবস্থান করে বিজ্ঞানীরা সমুদ্র নিয়ে, বিশেষ করে সামুদ্রিক প্রত্নতত্ত্ব, উদ্ভিদ ও প্রাণী, এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে শুরু করে সামুদ্রিক জীবনের অনেক রহস্য উদঘাটনে গবেষণা করবেন। অতীতে তৈরি যে কোনো সাবমেরিন আবাসের তুলনায় আকারে তিন-চার গুণ বড় এই ডুবো আবাসস্থল। ‘স্পাইরাল’ এই কেন্দ্রের চারপাশে ঘূর্ণায়মান গবেষণা কেন্দ্রটি সমুদ্রের তলদেশে পায়ার ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে। বিশেষ আকৃতির জন্য এটি সমুদ্রের তলদেশে বিভিন্ন ভূখণ্ডের সংগে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।

দ্বিতল কাঠামো হিসেবে নকশা করা এই ডুবো গবেষণা সেন্টারের মূল শৃঙ্খলে একাধিক মডিউলার পড রয়েছে, যেখানে একসংগে কয়েকটি ল্যাব, স্লিপিং কোয়ার্টার, বাথরুম, মেডিকেল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম এবং স্টোরেজসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা থাকছে। সম্পূর্ণরূপে বায়ু, সৌরশক্তি এবং মহাসাগরীয় তাপশক্তি রূপান্তরের মাধ্যমে চালিত প্রোটিয়াস স্টেশনটিকে বিশ্বের প্রথম ডুবো গ্রিনহাউস বলা যায়। এখানে কর্মরত গবেষকদের জন্য উদ্ভিদ জাতীয় খাবার উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন উদ্ভাবকরা। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গবেষক, শিক্ষাবিদ, সরকারি সংস্থা এবং কর্পোরেশনগুলোর যৌথ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অগ্রগতির সমন্বয়ে পরিচালিত স্টেশনটি ভবিষ্যত পৃথিবীর উন্নয়নে বৈশ্বিক সহযোগিতার এক অসাধারণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রোটিয়াসের প্রস্তুতি শেষ হবে।

সমুদ্রচারী ফ্যাবিয়ান কাস্টউ হলেন বিশ্ববিখ্যাত ওশেন এক্সপ্লোরার জ্যাকস কাস্টউ’র নাতি। জ্যাকস ছিলেন একাধারে ফরাসি নৌ-কর্মকর্তা, সংরক্ষণবাদী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী, ফটোগ্রাফার, লেখক এবং গবেষক। তিনি সমুদ্র এবং জলজ জীবনের প্রায় সব রূপ অধ্যয়ন করেছেন। ফ্রান্স একাডেমির এই সদস্য অ্যাকোয়া-ল্যাং (Aqua Lung)-এর সহ-উদ্ভাবক। তাঁকে সমুদ্র সংরক্ষণের অগ্রদূত বলা হয়। আধুনিক স্কুবা ডাইভিংয়ের জনকও হলেন এই জ্যাকস কাস্টউ। তিনি ১৯৬১ সালে প্রথম কনসেলফ ওয়ান (Conshelf One or Continental Shelf Station One) নামে আন্ডারওয়াটার হাউজিং তৈরি করেন, যেখানে দু’জন স্কুবা ডাইভার সাগরতলের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১২ মিটার গভীরে দুই সপ্তাহ অতিবাহিত করেন। এর পরের বছর আরও উন্নত ও বৃহৎ পরিসরের স্টারফিশ আকৃতির কনসেলফ টু (Conshelf Two)-তে লোহিত সাগরের ১০ মিটার গভীরে ৩০ দিনের আন্ডারওয়াটার লাইভ এক্সপেরিয়েন্স করেন ৬ জন সমুদ্রচারী।

কম্পিউটার উৎপাদিত চীনের গভীর সমুদ্রে পরিকল্পিত ‘স্পেস স্টেশন’-এর চিত্র

কম্পিউটার উৎপাদিত চীনের গভীর সমুদ্রে পরিকল্পিত ‘স্পেস স্টেশন’-এর চিত্র

মূলতঃ পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসরণ করেই ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞানী জ্যাকস ইভেস কাস্টউ’র নাতি খ্যাতনামা গবেষক ও সংরক্ষণবিদ ফ্যাবিয়েন কাস্টউ গভীর সমুদ্রে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস)-এর আদলে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ডুবো বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করছেন। একটি চাইনিজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দৈনিকের বরাতে জানা যায়, চীনও গভীর সমুদ্রে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ‘মহাকাশ স্টেশন’ তৈরির পরিকল্পনা করছে। এটি কয়েক ডজন বিজ্ঞানী বহনে সক্ষম হবে। পৌঁছাতে পারবে সমুদ্রের ১০০০ মিটার গভীরে। স্টেট কী ল্যাবরেটরির পরিচালক মিস্টার ইয়ান কাই-এর মতে, আন্ডারওয়াটার স্টেশনটি বিভিন্ন সমুদ্রের গবেষণা কাজের সুবিধার্থে মনুষ্য পরিচালিত ও সমুদ্রে নিমজ্জিতদের বিভিন্ন ছোট ছোট সরঞ্জাম দিয়ে পূর্ণ করা হবে। স্টেশনটি গভীর সমুদ্রে প্রাণিচাষ, তেল-গ্যাস সন্ধান এবং সম্ভাব্য চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য জীবের জিন বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা হবে। এছাড়াও গৃহীত পরিকল্পনায় রয়েছে, প্রতিটি মিশনে সময়ের দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে জ্বালানি কোষ, পারমাণবিক শক্তি বা এমনকি এখনও আবিষ্কার হয়নি এমন আন্ডারওয়াটার উপযোগী নতুন শক্তি ব্যবহার করা হবে। গভীর সমুদ্রে যোগাযোগ এবং নেভিগেশন, যথার্থতা এবং নির্ভুলতা নিয়ন্ত্রণ, ১০০০ মিটার গভীরতায় তীব্র চাপ মোকাবিলায় উপযোগী করে ডিজাইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বসহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

মহাসাগরের তলায় বসে কাজ করতে সক্ষম একটি গবেষণা স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা চীনের ২০৩০ সালের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী পরিকল্পনায় বিশেষ বিবেচ্য বিষয়; যা তাদের ১৩তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০২০) রয়েছে।

লেখকঃ চেয়ারম্যান, ওশেনোগ্রাফি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সমুদ্র বিজ্ঞানী এবং প্রেসিডেন্ট, ব্লু গ্রীন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

(বাংলাভিশন থেকে সংগৃহিত)

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

oceantimesbd.com