সুনীল অর্থনীতি: অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ

ব্লু ইকোনোমি বলতে সমুদ্র ভিত্তিক অর্থনীতিকে বোঝায়। ব্লু ইকোনোমি একটি অর্থনৈতিক শব্দ, যাতে একটি দেশের সামুদ্রিক পরিবেশকে এবং সামুদ্রিক পরিবেশের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়।

মূলত ব্লু ইকোনমি হলো গ্রিন ইকোনোমির সম্প্রসারিত আরেকটি রূপ। ইকোনমিক অঞ্চল একটি দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিত করে। বিশ্ব ব্যাংকের মতে ‘ব্লু ইকনোমি একটি ধারণা, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং জীবিকার সংরক্ষণকে উন্নীত করতে চায় এবং একই সাথে সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।’

১৯৯৪ সালে বেলজিয়ামের অধ্যাপক গুন্টার পাউলি সর্বপ্রথম ব্লু ইকোনমি র ধারণা দেন। জাতিসংঘ ব্লু ইকোনোমিকে মহাসাগর সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি পরিসর হিসেবে উল্লেখ করে।

ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল বিষয় হলো- টেকসই মাছ ধরা, সমুদ্র স্বাস্থ্য, বন্যপ্রাণী এবং দূষণ বন্ধ করা। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র টেকসই তার উপর একটি উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করে, যা ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG, Sustainable Development Goals) কেন্দ্রিক।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) এর ১৪ নম্বর লক্ষ্যে লাইফ বিলো ওয়াটার অর্থাৎ টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহারের বিষয়ে এবং সমুদ্রের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দাবী জানায়।

প্রতিনিয়ত পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। আর এ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য ২০১৫ সালে প্যারিসে একটি চুক্তি করা হয়েছিল। যাতে আমাদের সবুজমনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বমূলক ভূমিকা রেখেছিলেন।

সেদিন তিনি সেখানে বলেছিলেন, ‘সুনীল অর্থনীতিকে সামনে রেখে সমুদ্রে অব্যবহৃত ও এর তলদেশে অউন্মোচিত সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে এই অঞ্চলে যার যার টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করার সুযোগ রয়েছে।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘শান্তি, নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে গিয়ে যেন সমুদ্রের সুস্থ পরিবেশ বিঘ্নিত না হয়। তাই আমাদের সুনীল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি সুনীল চিন্তাও করতে হবে এবং সে লক্ষ্যে সমন্বিত লাভজনক ও সর্বোপরি সমুদ্র সংরক্ষণমূলক নীতি নির্ধারণ ও সে অনুযায়ী কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হবে।’

একই সঙ্গে তিনি এই আশার বাণী উচ্চারণ করেন যে, ‘২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৯ বিলিয়ন মানুষের জীবন ধারণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এই সুনীল অর্থনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’

সমুদ্র জয়ের পর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। এটা ঠিক যে, বিশাল সমুদ্রসীমা জয়ের ফলে বাংলাদেশের সামনে জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও বন্দর সুবিধা বৃদ্ধি, মৎস্য ও জলজ সম্পদসহ সমুদ্রতলদেশে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং পর্যটন ব্যবসা সম্প্রসারণ ইত্যাদি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমাদের যতটা জানা তার চেয়ে বেশি অজানা বিশাল সম্পদের আধার সমুদ্র।

বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানার মধ্যে শুধু বিপুল মৎস্য ভান্ডার নয়,রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ভান্ডারও। বিশেষ গঠন-প্রকৃতির কারণেই তেল-গ্যাস সহ নানা খনিজ সম্পদ সঞ্চিত রয়েছে আমাদের সাগরের তলদেশে।

বাংলাদেশের সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’র তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্র থেকে মাছ ধরেই শুধু বিদেশে রপ্তানি করে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ আয় করা সম্ভব। ‘সেভ আওয়ার সি’ এর সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ আনোয়ারুল হকের মতে, ‘সমুদ্রসম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো গেলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে যেতে পারে।’ তার মতে, শুধু সামুদ্রিক মাছ ও শৈবাল রপ্তানি করে বাংলাদেশ বছরে এক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ আয় করতে পারে।’

ব্লু ইকোনোমি বা সমুদ্র অর্থনীতি ক্রমশ জনসাধারণের কাছে পরিচিত হচ্ছে। আমাদের দেশের সমুদ্র গভীরে রয়েছে অগণিত সম্পদের। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সম্পদের ব্যবহার বাংলাদেশকে যেমন দিতে পারে আগামী দিনের জ্বালানি নিরাপত্তা, ঠিক তেমনি বদলে দিতে পারে সামগ্রিক অর্থনীতির চেহারাও। এমনকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাও সম্ভব।
বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতিবছর প্রায় ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরা যেতে পারলেও আমরা মাত্র ০.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরতে পারছি (কালের কন্ঠ, ১লা জুন ২০১৭)। মূলত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে মাছ আহরণ বাড়বে। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরে ভারি খনিজের সন্ধান পাওয়া গেছে। ভারি খনিজের মধ্যে রয়েছে ইলমেনাইট, টাইটেনিয়াম অক্সাইড, জিরকন ইত্যাদি। যা অত্যন্ত মূল্যবান।

এসব মূল্যবান সম্পদ ঠিকভাবে উত্তোলন করতে পারলে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বাংলাদেশ। তাছাড়াও বাংলাদেশে রয়েছে ব্যাপক পর্যটন স্থান। উপকূলীয় পর্যটন থেকে বিশ্বের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন)’র ৫% আসে এবং বিশ্বের ৬-৭% মানুষের কর্মস্থান এই খাতে থেকে হয়। বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বালুময় সমুদ্র সৈকত (১২০কি.মি. দৈর্ঘ্য)।

যা কক্সবাজার নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে কক্সবাজারের উপকূল অঞ্চলে পর্যাপ্ত বিনোদন ও মনোরম পরিবেশের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে। মূলত সমুদ্রকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নই হলো বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমি।

পৃথিবীতে যে কোনো কাজই সহজে করা যায় না। সকল কাজেরই থাকে বিভিন্ন অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জ। সে সকল অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা করেই সামনে এগিয়ে যাওয়া লাগে। ঠিক তেমনি বিশ্বের দরবারে তালে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্লু ইকোনমির উন্নয়নে রয়েছে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ।

চ্যালেঞ্জগুলো হলো
পর্যাপ্ত নীতিমালার ও সঠিক কর্ম পরিকল্পনার অভাব, দক্ষ জনশক্তির অভাব, ব্লু ইকোনমি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগের অভাব, প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব, মেরিন রিসোর্সভিত্তিক পর্যাপ্ত গবেষণা না হওয়া।

এ সকল চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারলেই বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে ব্লু ইকোনমিতে সার্থক দেশ হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে। বঙ্গোপসাগরে বিস্তৃত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চলে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।

বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনা ও সম্পদ চিহ্নিতকরণ, পরিমাণ নির্ধারণ ও জাতীয় উন্নয়নে পরিবেশের যথাযথ ব্যবহারকে সামনে রেখে পর্যাপ্ত গবেষণার জন্যই বাংলাদেশ সরকার ১৬জানুয়ারি, ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ ওসানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। যা কক্সবাজারে অবস্থিত।

বিশ্বের জনসংখ্যার ৪০% ইকোনোমিক অঞ্চলের কাছাকাছি বাস করে। ৩ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সমুদ্রকে ব্যবহার করে। অন্যদিকে সমুদ্র আমাদের নানাভাবে উপকার করলেও এই সাগর-মহাসাগরগুলো মানুষের নানা কাজের মাধ্যমেই হুমকির মধ্যে রয়েছে। আমাদের সকলের উচিত ব্লু ইকোনমির ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সমুদ্রকে রক্ষা করা এবং দেশকে বিশ্ব দরবারে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

লেখক: শিক্ষার্থী, ওশানোগ্রাফি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , ,

সব সংবাদ

For add

oceantimesbd.com