অতিরিক্ত পর্যটকের ভিড়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে সেন্টমার্টিন

অতিরিক্ত পর্যটকের ভিড়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বিশ্বের অন্যতম কোরাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। দেশে পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর অন্যতম এই সেন্টমার্টিন দ্বীপ। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে নাফ নদীর মোহনায় এ দ্বীপটির অবস্থান। দ্বীপটি রক্ষায় সরকার এমপিএ (মেরিন প্রোটেক্টট এরিয়া) ঘোষণা করলেও এর কোনো বাস্তবায়ন নেই।

জানা গেছে, এর আগে সরকার ইসিএ (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া) ঘোষণা করলেও দ্বীপটিতে পর্যটকের চাপ কমাতে পারেনি। দ্বীপ রক্ষায় এরপর সরকার এমপিএ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়; কিন্তু এতো কিছুর পরও দ্বীপে দেশি পর্যটকের ভিড় কমাতে পারেনি। বরং আরও বেড়েছে।

এ নিয়ে পরিবেশ সংগঠনগুলো নিয়মিত প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। শঙ্কার কথা প্রকাশ করছে। দ্বীপ রক্ষায় নানা পরামর্শ দেয়ার পরও সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ নেই। যার ফলে, দ্বীপটিতে প্রতিনিয়তই স্থাপনা নির্মাণ বাড়ছে। যা এখানকার পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, কেউ বলেন প্রায় ৫০০০ বছর, আবার কেউ বলেন প্রায় ১০ হাজার বছর আগে টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল সেন্ট মার্টিন। তবে, ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের পানির নিচে হারিয়ে যায়। এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া জেগে ওঠে। এর শতাধিক বছর পর উত্তর পাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে ওঠে। প্রায় ২৫০ বছর আগে প্রথম আরব বণিকদের নজরে আসে দ্বীপটি।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের সময় আরব বণিকরা এ দ্বীপটিতে বিশ্রাম নিতো। তখন তারা এ দ্বীপের নামকরণ করেছিল জাজিরা। দ্বীপটিতে প্রচুর নারকেল গাছ থাকার কারণে কালক্রমে জাজিরার অপভ্রংশ জিঞ্জিরা এবং তার আগে নারকেল যোগ করে এটি নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিতি লাভ করে।

বিভিন্ন কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে জানা যায়, প্রায় ৩৩ হাজার বছর আগে এ এলাকায় প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। স্বচ্ছ পানি ও চারপাশজুড়ে প্রবাল পাথরবেষ্টিত দ্বীপটি খুবই মনোরম। দেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের পার্শ্ববর্তী ৮.৩ বর্গকিলোমিটারজুড়ে এটির অবস্থান। দেশের একমাত্র এই প্রবাল দ্বীপ সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্রও।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সেন্টমার্টিনে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক বা কড়িজাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২ প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির প্রাণীর বসবাস ছিল। এসব প্রাণীর অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত প্রায় বা বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এ জীববৈচিত্র্য। সেন্টমার্টিন দ্বীপের সর্বদক্ষিণ অংশকে বলা হয় ছেঁড়া দ্বীপ, স্থানীয় ভাষায় ছেঁড়াদিয়া।

এ দ্বীপের চারদিকে রয়েছে প্রবাল, পাথর, ঝিুনক, শামুকের খোলস, চুনা পাথরসহ কয়েকশ প্রজাতির সামুদ্রিক জীব। অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ, যথেচ্ছ হোটেল-মোটেল নির্মাণ, নির্বিচারে গাছ কেটে বন উজাড়, মানুষের মলমূত্রসহ নানা বর্জ্য ও প্লাস্টিক সামগ্রির বর্জ্যে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির পরিবেশ-প্রতিবেশে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

এছাড়া পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক পাম্প দিয়ে প্রতিনিয়ত মিষ্টি পানি উত্তোলন, বহুতল ভবন নির্মাণ, ভবনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং খোলা পায়খানা নির্মাণসহ নানা পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে প্রবালসহ দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য।

দ্বীপটিতে স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এছাড়া প্রতিদিন গড়ে আরও ১০ হাজার পর্যটক সেখানে অবস্থান করে। ফলে ২০ হাজার মানুষের চাপ নিতে হয় দ্বীপটিকে। তাই দ্বীপটি এতটাই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে যে, হারাতে বসেছে তার রূপ-সৌন্দর্য্য। চারদিকের বাতাসে দুর্গন্ধ। বলতে গেলে সেন্টমার্টিন তার জীববৈচিত্র্য খোয়াতে খোয়াতে এখন মুমুর্ষু প্রায়।

পরিবেশবাদী কিছু সংগঠন ছাড়া এর অযত্ন ও অবহেলা নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে দেখা যায় না। সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় যে কোনো ধরনের প্লাস্টিক মোড়কজাত খাবার, ক্যান ও প্লাস্টিকের বোতল সেখানে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা জরুরি।

সেন্টমার্টিনে আন্ডারওয়াটার ক্লিনিংয়ের মাধ্যমে পানির নিচে যে জমে থাকা প্লাস্টিক ও দূষণকারী অন্য যে সব উপাদান রয়েছে তা নিয়মিত পরিষ্কার করা জরুরি।

পর্যটকদের আগমনকে নিরুৎসাহিত না করে বরং সহনীয় নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বাঁচানোর চেষ্টা করা প্রয়োজন। তাহলে সেন্টমার্টিন দ্বীপ টিকে থাকবে আরও হাজার বছর। রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র্যও।

(পরিবেশ ও গণমাধ্যমকর্মী)

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , , ,

oceantimesbd.com