বাংলাদেশের ব্লু ইকোনোমি আসলে কোন পথে!

ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি হচ্ছে সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদ। সাগরের জলরাশি, মৎস্য ভান্ডার আর খনিজ সম্পদে ভরপুর হলো সুনীল অর্থনীতি। সমুদ্র থেকে যে সম্পদই মানুষ আহরণ করুক না কেন, সেটাই হবে ব্লু ইকোনোমি।

অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে থাকে। পিছিয়ে নেই ইন্দোনেশিয়া, জাপান, ফিলিপাইন। বাংলাদেশে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা থাকলেও এখানে সরকারি-বেসরকারি তেমন কোন বিনিয়োগ নেই। তাহলে বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতি কোন পথে এগুচ্ছে?

জানা গেছে, ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার মামলায় মোট প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায় বাংলাদেশ। সেন্টমার্টিনস দ্বীপের জন্য ১২ নটিক্যাল মাইল রাষ্ট্রাধীন সমুদ্র এলাকা, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বি-পক্ষীয় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল সীমানা এবং মহীসোপানে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ।

এরপর ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্র সীমানার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এতে করে বাংলাদেশের জন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে উত্তরণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক সম্পদের গুরুত্ব ও অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়।

দেশের সমুদ্রসীমায় মোট ২৬টি তেল-গ্যাস ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে অগভীর অংশে ১১টি ও গভীর সাগরে ১৫টি। সীমানাবিরোধ নিষ্পত্তির পর ভারত ও মিয়ানমার দ্রুতগতিতে বঙ্গোপসাগরে তাদের অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়।

সাগরের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সক্ষমতাই নেই আমাদের। বিদেশি কোম্পানিগুলোর সহযোগিতা নেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানাবিধ জটিলতা। ফলে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস থাকলেও তা উত্তোলন করতে পারছে না বাংলাদেশ।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে ডাকা অন্য একটি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১ এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ও স্টেট ওয়েল

পেট্রোবাংলা জানায়, যুক্তরাষ্ট্র্রভিত্তিক তেল-গ্যাস কোম্পানি কনোকো ফিলিপস ২০০৮ সালের দরপত্র প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্রের ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ ব্লক ইজারা নিয়েছিল। দুই বছর অনুসন্ধান কাজ করার পর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মতভেদের কারণে ২০১৪ সালে ব্লক দুটি ছেড়ে দেয় কোম্পানিটি।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে ডাকা অন্য একটি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১ এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ও স্টেট ওয়েল। পরে কনোকো নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় ব্লকগুলো ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

সাগরে তেল-গ্যাসের সন্ধান পেলেও তা থেকে সুফল পেতে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লাগে। ২০১৪ সালে ব্লক দুটো ছেড়ে না দিলে বর্তমানের এই ক্রান্তিকালে বঙ্গোপসাগরের তেল-গ্যাস বাংলাদেশ ভোগ করতে পারতো।

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রবিজয়ের আগে ২০১১ সালের জুন মাসে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ব্লক ডিএস-১০ ও ১১ এর জন্য কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে একটি চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী ব্লক দুটিতে পাঁচ হাজার ৮শ লাইন কিলোমিটার ২ডি সার্ভে করা হয়। ওই সময় কনোকো ফিলিপস চুক্তিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করে। বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তারা ২০১৪ সালে ব্লক দুটি ছেড়ে চলে যায়।

২০১৬ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা জয়ের পর ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ব্লক ডিএস-১২ এর জন্য পসকো দেউয়ের (POSCO Daewoo) সঙ্গে আরেকটি চুক্তি সই হয়। এ ব্লকে ৩ হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার ২ডি সার্ভে করা হয়

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রবিজয়ের পর বাংলাদেশ অফশোর বিডিং রাউন্ড (দরপত্র) ২০১২ এর আওতায় ওএনজিসি ভিডেস লিমিটেড, অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের সঙ্গে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লক এসএস ০৪ এবং ০৯ – এর জন্য দুটি চুক্তি সই হয়। ব্লক দুটিতে ৫ হাজার লাইন কিলোমিটার ২ডি সার্ভে করা হয়। সার্ভের পর তারা ২০২২ সালের মার্চ মাসে ব্লক এসএস ০৪-এ একটি কূপ খনন করে। কিন্তু কূপটিতে গ্যাস পাওয়া যায়নি।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ওএনজিসি ব্লক এসএস-০৪ এবং ০৯- এ আরও দুটি কূপ খনন করার কথা ছিল। একই বিডিং রাউন্ডের আওতায় ২০১৪ সালের মার্চ মাসে অগভীর সমুদ্রের ব্লক এসএস-১১ এর জন্য সান্তোসের সঙ্গে একটি চুক্তি সই হয়। এ ব্লকে ৩ হাজার ১০০ লাইন কিলোমিটার ২ডি সার্ভে করা হয়। ব্লকটি সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও সান্তোস এশিয়া থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ায় ২০২০ সালে এ ব্লকটি ছেড়ে চলে যায়।

২০১৬ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা জয়ের পর ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ব্লক ডিএস-১২ এর জন্য পসকো দেউয়ের (POSCO Daewoo) সঙ্গে আরেকটি চুক্তি সই হয়। এ ব্লকে ৩ হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার ২ডি সার্ভে করা হয়। চুক্তির শর্তাবলি তাদের ব্যবসার জন্য অনুকূলে না হওয়ায় ২০২০ সালে তারাও ব্লকটি ছেড়ে চলে যায়।

নতুন বিডিং রাউন্ডের মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য অফশোর মডেল পিএসসি (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট)-২০১৯ এর আওতায় আন্তর্জাতিক বিড আহ্বানের কথা থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

চুক্তি অনুযায়ী ব্লক দুটিতে ৫ হাজার ৮০০ লাইন কিলোমিটার ২ডি সার্ভে করা হয়। ওই সময় কনোকো ফিলিপস চুক্তিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করে।

কোভিডের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে এ সেক্টরের দৃশ্যপট অনেকটা পরিবর্তন হওয়ায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে অফশোর মডেল পিএসসি (প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট)-২০১৯ আরও আধুনিক করার লক্ষ্যে জুন ২০২২ মাসে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। পরামর্শকের মতামত পাওয়ার পর নতুন অফশোর মডেল পিএসসি চূড়ান্ত করা হবে। নতুন অফশোর বিড রাউন্ড (দরপত্র) আহ্বান করা হবে বলে জানায় পেট্রোবাংলা।

ভারত-মিয়ানমার এগিয়ে থাকলেও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পিছিয়ে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পেট্রোবাংলা কিন্তু বসে নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রবিজয়ের আগেই গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ব্লক ডিএস-১০ ও ১১ এর জন্য কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করি।

চুক্তি অনুযায়ী ব্লক দুটিতে ৫ হাজার ৮০০ লাইন কিলোমিটার ২ডি সার্ভে করা হয়। ওই সময় কনোকো ফিলিপস চুক্তিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করে। বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তারা ২০১৪ সালে ব্লক দুটি ছেড়ে চলে যায়।

এটা না হলে বাংলাদেশ এখন বঙ্গোপসাগরের তেল-গ্যাস ব্যবহার করতে পারতো। কারণ একটি ব্লক থেকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের পর আহরণ করতে পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লাগে। আসলে কোনো একটি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে। তাই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে হলে উভয়পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। তা না হলে হবে না।

তিনি আরও বলেন, নতুন উদ্যমে আবারও আমরা কাজ শুরু করবো। নতুন অফশোর বিড রাউন্ড (দরপত্র) আহ্বান করা হবে।

পৃথিবীর জনসংখ্যা দিন দিন যেভাবে বেড়েই চলেছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটির মত। ভাবুন একবার! এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর খাদ্যের যোগান দেয়া কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে! তাই সমুদ্র নির্ভর এই বিকল্প অর্থনীতির গুরুত্ব বাড়ছে বিশ্বজুড়ে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র নানাভাবেই অবদান রেখে চলেছে। প্রাপ্ত তথ্যে বলা হচ্ছে, বিশ্বের ৪৩০ কোটিরও বেশি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে।

ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদনির্ভর। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যে, যা পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা গেলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান জাতীয় বাজেটের দশগুণ হবে।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে থাকে। ২০২৫ সালে এ খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সে দেশের সরকার।

এছাড়াও চীন, জাপান, ফিলিপাইনসহ বেশকিছু দেশ ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগেই সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছে। অন্যদিকে বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রাণিসম্পদ ছাড়াও ১৩টি জায়গায় আছে মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম। এগুলোতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইটের মতো মূল্যবান ধাতব উপাদান

বাংলাদেশের মালিকানায় রয়েছে বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিশাল এ জলসীমাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

বাংলাদেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ বিদ্যমান তার সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, এই সম্পদের প্রায় সমপরিমাণ (৮১ শতাংশ) সম্পদ সমুদ্র তলদেশে আছে।

বাংলাদেশ যে অঞ্চলের মালিকানা পেয়েছে, সেখানে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করা সম্ভব। এই ক্ষেত্র চারটি হলো তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন।

বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ও জৈব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আছে। ২০১৭-১৮ সালে দেশে উৎপাদিত মোট ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার মাছের মধ্যে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টনই এসেছে সমুদ্র থেকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রাণিসম্পদ ছাড়াও ১৩টি জায়গায় আছে মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম। এগুলোতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইটের মতো মূল্যবান ধাতব উপাদান। তাছাড়া সিমেন্ট বানানোর উপযোগী প্রচুর ক্লে রয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্র তলদেশে।

বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা দেশের মূল ভূ-খন্ডের প্রায় সমান। অথচ দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের মাত্র ১৫.৪২ ভাগ অবদান সামুদ্রিক মাছের। এ সমুদ্র এলাকায় বছরে ৮০ লাখ টন মাছ ধরার সুযোগ আছে।

এদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৪ নম্বর ধারায় টেকসই উন্নয়নের জন্য সামুদ্রিক সম্পদের অনুসন্ধান ও সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি পূরণের লক্ষ্যে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের গুরুত্ব অপরিসীম।

২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ‘টুয়ার্ডস এ ব্লু ইকোনমি: এ পাথওয়ে ফর সাসটেইনেবল গ্রোথ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি সমীক্ষাতে বলা হয়েছে, সমুদ্র অর্থনীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো সমন্বিত নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশিদের আকৃষ্ট করার জন্য যে ‘মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে’ চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর্যায়ে বারবার আটকে গেছে।

‘সমুদ্র বিজয়’ নিয়ে যতটা মাতামাতি হয়েছে, সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে ততটা উদ্যোগ কিন্তু পরিলক্ষিত হয়নি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে ‘ব্লু ইকোনমি সেল’ নামে একটি ক্ষুদ্র প্রশাসনিক সেল গঠন ছাড়া তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

বর্তমানে বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩২ বর্গকিলোমিটার। এই সমুদ্রসীমা অগাধ প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার, যা আমাদের দেশের বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার সম্পূর্ণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। কিন্তু বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ এখন পর্যন্ত প্রায় অনাবিষ্কৃত ও অব্যবহৃত

এদিকে ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন উপকূলীয় দেশ ও দ্বীপের সরকারগুলো অর্থনীতির এক নতুন ফ্রন্ট হিসেবে সমুদ্রের দিকে নজর দিতে শুরু করেছে। এবং সমুদ্র অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে দেশের প্রবৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করছে।

বাংলাদেশ কেন পারছে না তাহলে? এর একটা কারণ- সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের বড় অভাব রয়েছে বাংলাদেশে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য একসাথে করে বিশ্বব্যাংক একটি হিসাব করে বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্লু ইকোনমির অবদান (বা গ্রস ভ্যালু এডেড) ছিল ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা মোট অর্থনীতির মাত্র ৩ শতাংশ।

কোন খাত সমুদ্র অর্থনীতিতে কতটা ভূমিকা রেখেছে, তারও একটি হিসাব করা হয়েছে- পর্যটন ২৫ ভাগ, সমুদ্র থেকে মাছ ধরা এবং অ্যাকুয়াকালচার ২২ ভাগ ও তেল-গ্যাস সম্পদ ১৯ ভাগ। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে হিসাবটি করা হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩২ বর্গকিলোমিটার। এই সমুদ্রসীমা অগাধ প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার, যা আমাদের দেশের বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার সম্পূর্ণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। কিন্তু বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ এখন পর্যন্ত প্রায় অনাবিষ্কৃত ও অব্যবহৃত। সমুদ্রসম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

তবে ইতিবাচক তথ্য হল, ২০১৬ সাল থেকে আরভি মীন সন্ধানী নামের সমুদ্র গবেষণা ও জরিপ-জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রের চিংড়িসহ তলদেশীয় ও উপরিস্থ মাছের জরিপের কাজও চলছে। যার কার্যক্রম সাগরের ২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত।

যদিও আরভি মীন সন্ধানী জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রে সব অঞ্চলে জরিপ চালানো সম্ভব নয়। তাই ২০১৮ সাল থেকে সাগরের মাছ, পানিসহ বিভিন্ন উপাদানের নমুনা সংগ্রহ ও গবেষণা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ফ্রিডজফ ন্যানসেন নামের নরওয়ের একটি জাহাজ।

চলতি বছরের ২ থেকে ১৭ আগস্ট এ বঙ্গোপসাগরের ৫ হাজার ২০০ কিলোমিটার এলাকায় দেশের ১৮ জন সহ মোট ৩০ জন বিজ্ঞানী নিয়ে এ জরিপ চালানো হয়। জরিপের ফলাফল বের হলে মাছ ও জলজ উদ্ভিদের প্রজাতি এবং মজুদসহ জানা যাবে নানা তথ্য।

(পরিবেশ ও গণমাধ্যম কর্মী)

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , ,

oceantimesbd.com