পরিবেশ রক্ষায় সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকার চাই

এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে শামিল হই সকলে’। প্লাস্টিকের ব্যবহার দেশে ১৫ বছরে দাঁড়িয়েছে তিন গুণ। যদিও বাংলাদেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ৫-৭ কেজি, যা বৈশ্বিক মাথাপিছু গড় ৫০ কেজির চেয়ে অনেক কম। কিন্তু ওসিডির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্লাস্টিক বর্জ্য অব্যবস্থাপনার দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। প্লাস্টিক নিয়ে বিস্তারিত বলার আগে আলোকপাত করতে চাই দেশের প্রধান প্রধান পরিবেশ সমস্যা নিয়ে।

আমরা সবাই জানি, ঢাকার বাতাস প্রায় বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বাতাসের স্থান দখল করছে। বছরে ৩৩৭ দিনই ঢাকার বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের নিচে থাকে। চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসেই মোট ৯ দিন ঝুঁকিপূর্ণ বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েছে নগরবাসী, যা অভূতপূর্ব। মে মাসের শেষদিকেও বায়ুমান পর্যবেক্ষণ সূচকে নগরীর বাতাস পরপর তিন দিন অস্বাস্থ্যকর এবং পৃথিবীর সর্বোচ্চ দূষিত ছিল। এবার নগরবাসী দূষিত বাতাসের পাশাপাশি রেকর্ড ভেঙে দেওয়া গরমের সঙ্গেও চলেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই গরম থেকে বাঁচাতে ঢাকা মহানগরে যতটুকু জলাধার ও সবুজ থাকা দরকার, তার কতটুকু আছে? কতটুকু আমরা ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন হওয়ার পর হারিয়েছি? এর একটি চিত্র বিশ্ব পরিবেশ দিবস, ২০২৩ উপলক্ষে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) প্রকাশ করেছে।

বিআইপির গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে ঢাকায় জলাধার ও জলাভূমির পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৫৮ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে কৃষিজমিসহ সবুজ ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৩৫ দশমিক ৭১ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৩১ শতাংশে। ১৯৯৫ সালে ঢাকা মহানগরীতে সবুজ এলাকা ছিল ১৯ দশমিক ৭৮ বর্গকিলোমিটার বা ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে এসে সবুজ এলাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪২ বর্গকিলোমিটার বা ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে।

অর্থাৎ একটি আদর্শ শহরে ১৫ শতাংশ সবুজ ভূমি থাকার কথা। তার বিপরীতে আমাদের আছে ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আর ১০-১২ শতাংশ জলাভূমির আদর্শ মানদণ্ডের বিপরীতে আমাদের রয়েছে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। উন্নয়নের যে সংজ্ঞা ও বর্ণনা আমাদের সচরাচর দেওয়া হচ্ছে, তারই ফল হচ্ছে সবুজ ও নীলে কংক্রিট আর নির্মাণের এমন নগ্ন আগ্রাসন। ঢাকা কিন্তু বিভীষিকাময় শব্দদূষণেরও স্বীকার। বিশ্বের ৬১টি জনবহুল নগরীর মধ্যে ঢাকাতেই শব্দদূষণ সর্বাধিক হিসেবে রেকর্ড করেছে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি। এ শব্দদূষণ ঢাকায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টাই অসহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে, যা নগরবাসীকে রীতিমতো বধির করে তুলছে।

এবার দেশের সার্বিক পরিবেশের ওপর আলোকপাত করা যাক। বন বিভাগের হিসাবমতে, দেশে বন এলাকার পরিমাণ ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যদিও তাদের দাবিকৃত এই পরিমাণের সঙ্গে এফএও বা ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন একমত নয়। দেশে চলছে বন উজাড় আর উন্নয়ন কাজে বন বরাদ্দ দেওয়ার বাধাহীন প্রক্রিয়া। দেশে বনের গাছ কাটা নিষিদ্ধ করা হলেও বন উজাড়ে যেন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। বন অধিদপ্তর ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে স্পষ্ট আপত্তি দিলেও সরকার কক্সবাজারের সংরক্ষিত বনভূমিতে বাফুফের টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। কক্সবাজারে কেন ফুটবলের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে হবে এবং তা কেন খাসজমি রেখে বিপন্ন এশিয়ার বন্যহাতির বিচরণক্ষেত্রেই হতে হবে– তার উত্তর নেই।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ ক অনুচ্ছেদে প্রত্যয় করা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।

এমন অঙ্গীকারের পরও বাংলাদেশে বন উজাড়ের হার বিশ্বে শীর্ষে। পুরো পৃথিবীর যেখানে বন উজাড়ের বার্ষিক গড় হার ১ দশমিক ৩ শতাংশ; বাংলাদেশে সে হার ২ শতাংশ। আইইউসিএনের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে ৭ ধরনের উদ্ভিদকে বিলুপ্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে; ৫টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে মহাবিপন্ন; ১২৭টিকে বিপন্ন; ২৬২টিকে ঝুঁকিতে থাকা আর ৬৯টিকে ঝুঁকির মুখোমুখি হিসেবে। ১ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে মাত্র ২৭১টিকে ভালোভাবে সংরক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর প্রায় অর্ধেকই কোনো না কোনো ঝুঁকিতে আছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। বারবার জলোচ্ছ্বাস আর ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র ঝুঁকিতে থাকা উপকূলের চকরিয়া, সুন্দরবন উজাড় হয়েছে বহু বছর আগেই। এবার হাত পড়েছে নিঝুম দ্বীপে। সেখানে পর্যটনের নামে উজাড় হচ্ছে বন। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব সুন্দরবন সামলাতে না পারলে দেশের প্রাকৃতিক বনের জীবনরেখা যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে, তা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বন বাঁচানোর সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মিলছে না। উপকূলে বনের পরিমাণ বাড়ানো না গেলে জলবায়ু পরিবর্তনসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে সুরক্ষা পাওয়ার প্রাকৃতিক কোনো ঢাল থাকবে না। ফলে দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। প্রাকৃতিক কৃষির পরিবর্তে রাসায়নিকনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে ত্বরান্বিত করবে। দেশে মোট জমির ৭৮ দশমিক ৯০ শতাংশে রয়েছে জৈব পদার্থের ঘাটতি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে আর উপকূলের কৃষিজমি সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেলে পুষ্টির ঘাটতিতে থাকা কৃষিজমি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করবে।

ফিরে আসি প্লাস্টিকের দূষণে। হাইকোর্ট দেশের নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা বললেও একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, নদীদূষণ এখন কেবল শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে এমন মহানগরীতেই সীমাবদ্ধ নয়। দূষণ এখন ছড়িয়ে গেছে গোটা বাংলাদেশেই। নদীতে শিল্পদূষণের পাশাপাশি পলিথিনদূষণও মারাত্মক পর্যায়ের। শুধু বাংলাদেশের নদীতেই নয়, আশঙ্কা করা হচ্ছে– এখনই ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে ২০৫০ সালে সমুদ্রে মাছের চেয়ে বেশি থাকবে মাইক্রোপ্লাস্টিক।

উপরের চিত্র থেকে স্পষ্ট, দেশের পরিবেশ ভালো নেই। বাজেটে পরিবেশের জন্য বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতা ও অঙ্গীকার বাড়ানো ছাড়া এ বাজেট বৃদ্ধি জনগণের কোনো কাজে লাগবে না। পরিবেশগত কর্মদক্ষতার দিক থেকে ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৭৯তে রেখে টেকসই উন্নয়নের দাবি বেমানান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পরিবেশ রক্ষার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার আদায় করে নিতে হবে পরিবেশকর্মীদের। যে উন্নয়ন বন উজাড় করে; নদী হত্যা করে; বাতাস আর মাটি বিষাক্ত করে, সে উন্নয়ন আত্মঘাতী। প্রকৃতি ধ্বংসের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে হবে আমাদের। আগামীর ভোটারদের পাশে পেতে হলে সরকারকে প্রচলিত উন্নয়নের ধ্যান-ধারণায় পরিবেশগত অধিকার ও ন্যায়বিচারের ধারণা সততার সঙ্গে সংযোজন করতে হবে।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক হচ্ছে বিশ্বকে প্লাস্টিক দূষণমুক্ত করতে। প্লাস্টিক রোধে হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন। ২০২৩ সালের পরিবেশ দিবসে আদালতের আদেশ মেনে এবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করবে এবং প্লাস্টিকবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব বলিষ্ঠ হবে, সেটিই প্রত্যাশা।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; প্রধান নির্বাহী, বেলা

সূত্র: দৈনিক সমকাল

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , ,

oceantimesbd.com