শীতলক্ষ্যায় দিনে ২০ কোটি লিটার শিল্পবর্জ্য

প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ। এ শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। এর পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ধলেশ্বরী নদী। শীতলক্ষ্যা নদী ও নারায়ণগঞ্জ শহর নিয়ে ইংরেজ সাহিত্যিক রুমার গডেন লিখেছেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য রিভার’। ১৯৪৬ সালে লেখা এ উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে পরবর্তীকালে ফরাসি চিত্রনির্মাতা জ্যঁ রেনোয়া চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন।

দ্য রিভার-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন ইংরেজ কিশোরী হ্যারিয়েট। তার চোখে স্রোতস্বিনী শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ জল, অসংখ্য নৌযান, গাঙচিল, মাছরাঙারসহ নানান পাখির ওড়াউড়ি। সেই শীতলক্ষ্যা এখন দূষণে ধূঁকছে। পানির রঙ কুচকুচে কালো, দুর্গন্ধময়। অথচ একটা সময় এ পানি গোসলসহ দৈনন্দিন নানান কাজে ব্যবহার হতো। এমনকি মানুষ পানও করত।

নদীতীরের ডাইং কারখানানহ বিভিন্ন কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ও শহরের বর্জ্য- মূলত এই দুই কারণে দূষিত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পলিথিন ও নৌযানের বর্জ্য। সম্প্রতি শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড় ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ির অপরিশোধিত বর্জ্য নর্দমা ও খালের মাধ্যমে সরাসরি নদীতে পড়ছে।

সম্প্রতি শহরের ৫ নং নৌঘাট থেকে শুরু করে ১ নং ঘাট, লঞ্চঘাট হয়ে নিতাইগঞ্জ পর্যন্ত নদীর পাড় ধরে হেঁটে দেখা গেল নদীর তীরে ময়লা-আবর্জনা পড়ে আছে। গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো বর্জ্য নেই, যা সেখানে ফেলা হচ্ছে না। কোথাও কোথাও জমে আছে আবর্জনার স্তূপ।

নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নর্দমা ও খাল-বিল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি লিটার শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য এই শীতলক্ষ্যা নদীতে এসে মিলিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে হোটেল রেস্তোরাঁ, বাসাবাড়ির পয়োবর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্যসহ পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য।

বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জে নানারকম শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এসব শিল্প কারখানার অনেকগুলোই তরল বর্জ্য নির্গমনকারী। নিয়ম অনুযায়ী এসব কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) থাকার কথা। কিন্তু অনেক কারখানায়ই তা নেই। এর মধ্যে ডাইং কারখানাগুলো অন্যতম। আবার যাদের ইটিপি আছে, পরিচলন ব্যয় বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই তা বন্ধ রাখছে বলে অভিযোগ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, পানিতে জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার জন্য ন্যূনতম ৪ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন। কিন্তু শীতলক্ষ্যার পানিতে আছে মাত্র শূন্য দশমিক ১মিলিগ্রাম।

তবে বর্ষাকালে কিছুটা বেড়ে ২ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। ফলে এই নদীতে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী বেঁচে থাকা দায়। পাশাপশি গৃহস্থালি কাজেও শীতলক্ষ্যার পানি ব্যবহারের উপযোগী নয়।

কল কারখানার বর্জ্যে নদীর পানি দূষিত ও নষ্ট হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠছে। শীতলক্ষ্যা নদীকে দূষণের কবল থেকে বাচাঁতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, সিটি করপোরেশনের পয়োবর্জ্য নদীতে পরিশোধন করে ফেলার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্লাস্টার ইটিপি বসানো হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে শীতলক্ষ্যা নদীর অবস্থার উন্নতি হবে, দূষণ কমবে। এ ছাড়া নদীর দখল-দূষণ কমাতে আরও কিছু প্রকল্প চলমান আছে। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে নদী আবার আগের রূপে ফিরে আসবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জানান, নারায়ণগঞ্জে প্রায় ৫০০ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আছে, যারা রাসায়নিক তরল বর্জ্য নির্গমন করে। এগুলোর মধ্যে ৩২৮টি প্রতিষ্ঠানে ইটিপি রয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি নর্দমা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলছে।

নদীদূষণ বন্ধে প্রতি মাসেই অভিযান পরিচালনা করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব কারখানায় ইটিপি নেই সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ইটিপি স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। যারা মানছে না তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে কারখানা সিলগালা করা হচ্ছে। সর্বোপরি নদীদূষণ বন্ধে কাজ করছি।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , ,

oceantimesbd.com