বঙ্গোপসাগর ‘ইজারা’, কোটি টাকার বাণিজ্য

‘জাল যার, সাগরের মাছ তার’—বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ক্ষেত্রে বছরের পর বছর এমন রীতেই চলে আসছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে এই রীতির পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে মাছ ধরতে হলে ক্ষমতাশীন দলের নেতাকর্মীদের মোটা অংকের চাঁদা দিতে হয়। পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী) আসনের সদস্য সদস্য (এমপি) মুহিবুর রহমান মুহিবের বিরুদ্ধে এমন রীতি প্রচলনের অভিযোগ উঠেছে। তবে এমপি মুহিব এ বিষয়ে তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন।

সম্প্রতি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চর হেয়ারে গিয়ে দেখা যায়, একদল জেলে জাল ফেলে মাছ শিকার করছেন। সেখানেই কথা হয় তাদের সঙ্গে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেলে মিডিয়াকে বলেন,  ‘এমপিরা বিড (ইজারা) দেয়। যে বিড রাইখ্যা আনে হেরতোন আমাগো রাইখ্যা জাল পাততে হয়। এবার আমাগো ৯০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এবার আমাগো দেশি লোকেই বিড নিছে।’

কে বিড নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শাহাজুল মীর। তার বাড়ি খালগোড়া। আর শাহাজুল মীর বিড আনছে বাবু তালুকদারের থেকে।’

বাবু তালুকদার কে, এমন প্রশ্নে এই জেলে বলেন, ‘বাবু তালুকদার টিপু তালুকদারের ছেলে। বাবু তালুকদার আনছে এমপি মুহিব মিয়ার কাছ থেকে।’

এই চরে মাছ ধরা আরেকজন জেলে বলেন, ‘আমরা তো জানি না উপর দিয়ে ডাক হয়। আমগো তো হেগো থেকে রাইখা মাছ ধরতে হয়।’

কত দিতে হয়, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা তো জানি না। আমরা তো মাছ ধরি। খুডাপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা দেই। এবার ডাক আনছে শাহাজুল মীর।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জেলে মিডিয়াকে বলেন, ‘আমরা সাগরে মাছ ধরি। গলাসমান পানিতে মাছ ধরতে হয়। সাগরে মাছ ধরলেও আমরা কিনারে জাল পাশাই (ফেলি)। হেই লইগ্যা আমাগে টাহা দেওয়া লাগে। এমন দিনও আছে যেদিন তেল খরচ বাদ দিয়া কিছুই পাই না। তয় টাহা না দেয়া লাগলে আমাগো লইগ্যা ভালো হইতো।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু চর হেয়ার (কলাগাছিয়া) নয়, বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা চরগুলোতেই এমন ইজারা কিংবা বিড দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে। সোনারচর, চর মন্তাজ, মেসের চর, জাহাজমারার চর, তুফানিয়া চরসহ উপকূলীয় এলাকার চরগুলো এবং এর আশপাশের সমুদ্র সৈকতে মাছ শিকারে জেলেদের নিয়মিতভাবে চাঁদা দিতে হচ্ছে।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চর ইজারার মাধ্যমে এই এলাকায় প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়। তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জেলেদের কাছ থেকে টাকা তুললেও রাঙ্গাবালী উপজেলায় যেসব চর ও বনের মধ্যে খালে মাছ ধরা হয়, সেগুলোতে মাছ শিকারের জন্য যে ইজারা কিংবা বিড প্রথা রয়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করেন এমপির কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত রাঙ্গাবালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাঙ্গাবালী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাইদুজ্জামান মামুন।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত বাবু তালুকদারের কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি চর ইজারা নেওয়া কিংবা জেলেদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষটি অস্বীকার করেন।

রাঙ্গাবালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুজ্জামান মামুনের কাছে এ বিষয়ে সরাসরি ক্যামেরার সামনে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে দৌড়ে স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করেন। পরে তিনি বলেন, ‘আমি ওইয়ার মধ্যে নেই। আমি টাকা নেই না, আমি জানি না। আমরা কোনো চর ইজারা দেই না । জননেত্রী শেখ হাসিনার সময়ে চর ইজারার কোনো প্রথা নেই। আমরা বলছি শুধু যার জাল আছে সেই মাছ ধরবে।’

এ বিষয়ে ক্যামেরার সামনে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মুহিব বলেন, ‘কে ইজারা দিচ্ছে? আমি তো চিনি না এগো । আমার এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। চর তো সরকারিভাবে ইজারা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর বাবু কিংবা শাহজুল মীরকে আমি চিনি না। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’

জানতে চাইলে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘সাগর কিংবা চর ইজারা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আপনাদের কাছে যেহেতু শুনলাম, এ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’

এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, বিষয়টি জানা নেই। তবে খোঁজখবর নিয়ে দেখছি।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

oceantimesbd.com