সংসারের খরচ মেটাতে শুঁটকি পল্লীতে শিশু শ্রমিক

সাগর থেকে একদিকে ফিশিং ট্রলার তীরে ভিড়ছে। অপরদিকে তীর থেকে রসদ নিয়ে সারি সারি ফিশিং ট্রলার সাগরে পাড়ি জমাচ্ছে। চার থেকে পাঁচ দিনের সাগর যাত্রায় জেলেরা মণের পর মণ টাইগার চিংড়ি ধরে নিয়ে তীরে ফিরে আসছে। এসব চিংড়ি ঘাটে এনে বিশেষ প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়। এরপর বিক্রির জন্য মোকামে পাঠানো হয়।

বিশেষ প্রক্রিয়ারকরণের কাজ করার জন্য আলাদা একঝাঁক শ্রমিক রয়েছে। যাদের কাজ টাইগার চিংড়ির মাথা আলাদা করা। মাথার অংশ ফেলে দিয়ে মূল মাছের অংশ মালিকপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়া। এ কাজের জন্য অবশ্য নির্ধারিত বেতন নেই কোন শ্রমিকের। যে যত বেশি চিংড়ির মাথার অংশ আলাদা করতে পারবে কেজি মূল্যে সে তত বেশি পারিশ্রমিক পাবে। তবে এ কাজে পুরুষ শ্রমিকের থেকে নারীদের সংখ্যা বেশি।

শুধু তাই নয়, নারীদের সাথে সমানভাবে কাজ করেছে যাচ্ছে শিশুরা। যাদের অনেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতে পারেনি। কথা বলে জানা গেলো তারা অনেকে এই কাজে এসছেন সংসার এবং লেখাপড়া খরচ মেটাতে বাবা-মায়ের সাথে বাড়তি রোজগারের আশায়।

শিশু বয়সে ছেলে-মেয়েদের এ কাজে প্রথমে নিরুৎসাহী হলেও ভবিষৎ বিবেচনা করে উৎসাহ দিচ্ছেন সংসারের কর্তা ব্যক্তিরা। ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবসে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের হিন্দুপাড়া গ্রাম সংলগ্ন বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর পাড়ে জমজমাট শুঁটকি পল্লীতে গিয়ে শিশু শ্রমিকের দেখা মিলেছে।

অভিভাবকরা বলছেন, শিশু নির্যাতন এই চরমোন্তাজে বেড়েই চলছে। আমার ঘরে আমার ছোট মেয়ে নিরাপদ নয়। নির্যাতিত হওয়ার চেয়ে বরং বাবা কিংবা মায়ের সাথে কাজ করবে। তাতে অন্তত চিন্তামুক্ত থাকি।

হিন্দুপাড়া গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেল, বছরে চার মাস এ এলাকায় কয়েক প্রজাতির মাছের শুঁটকি করা হয়। এতে নারী শ্রমিকরা কাজ করেন। এখানে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিকরা কাজ করে থাকে। এদের কেউ বেতনভুক্ত নয়। যে যত বেশি টাইগার চিংড়ির মাথা আলাদা করতে পারবে তাদেরকে কেজি প্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা করে মজুরি দেয়া হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেয়া যায়, বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর তীরে সাড়িবদ্ধভাবে বসে চিংড়ি কাটার কাজ করছে নারীরা, কেউ বা মাছের জন্য বসে রয়েছেন। অনেকে মজেছেন আড্ডায়। তখনই দেখা মেলে মায়ের পাশে বসে চিংড়ি মাছ কাটার কাজ করছেন সুকলা ও দুর্জয় মন্ডল। এর দুজনই ভাই বোন।

দুর্জয় কেবল মাধ্যমিকে পা রেখেছে আর সুকলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। কথা বলে জানা গেল, ছয় সদস্যের পরিবারে অর্থ যোগানদাতা বাবা ধীরেন মন্ডল। পেশায় মাছ শিকারি (জেলে)। যা রোজগার করেন তা দিয়ে সংসার চালানো দুষ্কর। সংসার খরচে সহযোগিতা করতে স্ত্রী মিতারা রানী শুরু করেন মাছ কাটার কাজ। মায়ের সাথেই ছেলে মেয়ে এগিয়ে আসে এ কাজে। এখন ওদের লেখাপড়া খরচ চালাতে ওরা’ই আয় করছে। এদিন সুকলা ও দুর্জয় ছাড়াও দেখা মিলেছে একাধিক শিশুর। যারা একই পরিস্থিতির কারণে এ কাজ করছেন।

খোজ নিয়ে জানা গেল, চরমোন্তাজ ইউনিয়নে চলতি বছরে তিনজন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে দু’জন নির্যাতনকারী জেলহাজতে রয়েছে। আর আরেকজন প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আইনি প্রত্রিয়ায় যায়নি শিশুটির পরিবার।

বেসরকারী সংস্থা জাগোনারী পরিচালক (যোগাযোগ) ডিউক ইবনে আমীন বলেন, ‘জাগোনারী শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। এবং শিশুরা যাতে কোন ধরনের সহিংসতা শিকার না হয় এবং কোন শিশু নির্যাতনের শিকার হলে তাকে আইনি সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। এছাড়াও শিশুদের লেখাপড়া নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হয়। সরকারের ঘোষিত শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে জাগোনারী সচেষ্ট আছে।’

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , , ,

oceantimesbd.com