৪ কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েও সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত দুবলার চরের শুঁটকিপল্লি

বছরে চার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব দিয়েও বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসা, নিরাপত্তাসহ সব ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকিপল্লির প্রায় ২৫ হাজার জেলে।

বন বিভাগের আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে বছরের পর বছর কেটে গেলেও এখনও মেলেনি কাঙ্ক্ষিত সেবা। এমন অবস্থায় শুঁটকিপল্লির জেলেদের বাধ্য হয়ে খেতে হয় কুয়ার পানি আর অসুস্থতায় তাদের ভরসা ফার্মেসির চিকিৎসা।

দুবলার চরের শুঁটকিপল্লির পক্ষে বন বিভাগকে চার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব দেয়া হলেও সরকারের কোনো উদ্যোগ না নেয়ার অভিযোগ ব্যবসায়ী নেতাদের। তবে সুপেয় পানি, চিকিৎসা ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাগেরহাট পূর্ব বন বিভাগের কর্মকর্তা। আর জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ক্যাম্প স্থাপনের কথা জানিয়েছে নৌ পুলিশ।

বাগেরহাট পূর্ব বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন সুন্দরবনের দুবলার চর, আলোর কোল, শ্যালার চর, নারকেল বাড়িয়া, মাঝের কেল্লা, অফিসকেল্লাসহ কয়েকটি চরে প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস চলে শুঁটকি আহরণ মৌসুম।

দেশের শুঁটকির মোট চাহিদার ৮০ ভাগ আসে দুবলার চর থেকে। লইট্টা, ছুরি, চিংড়ি, রূপচাঁদা, খলিশা, ইছা, ভেদা, পোঁয়াসহ শতাধিক প্রজাতির শুঁটকি তৈরি করা হয় এ পল্লিতে। শুঁটকি মৌসুম ঘিরে এখানে প্রায় ২৫ হাজার জেলে অবস্থান করেন।

বন বিভাগের তথ্য মতে, সুন্দরবনে শুঁটকি আহরণ মৌসুমে এসব চরে বাঁশ, কাঠ, ছন ও পলিথিন দিয়ে ছাপরা ঘর তৈরি করে বসবাস করে ১০ হাজার ছেলে। তবে জেলেদের দাবি প্রতি বছর শুঁটকি মৌসুমে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ হাজার জেলে অবস্থান করে সুন্দরবনের এসব চরে।

বন বিভাগের তথ্য মতে, গত অর্থবছরে জেলে ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এ বছর সাড়ে ৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বন বিভাগ।

জেলেদের অভিযোগ, বছরের এই পাঁচ মাস জীবিকার তাগিদে মৎস্য আহরণ কাজে নিয়োজিত জেলেদের খাবার পানির অভাব, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নিরাপত্তাসহ নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত।

খাবার পানির অভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হলেও মেলেনা চিকিৎসাসেবা। এ ছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে নেই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র। শুঁটকি ব্যবসায়ী ও জেলেরা জানান, আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর, তবুও মিলছে না সুপেয় পানি, আশ্রয়কেন্দ্র ও চিকিৎসাসেবা।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বাসিন্দা শুঁটকি ব্যবসায়ী মুজিবর রহমান বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে আমি ৪৭ বছর ধরে সুন্দরবনের এই শুঁটকিপল্লিতে মাছ আহরণ ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত আছি। বছরের নভেম্বর থেকে মার্চ এই ৫ মাস শুঁটকি মৌসুম। বন বিভাগকে রাজস্ব দিয়ে আমাদের এখানে আসতে হয়। শুধু শুঁটকি মৌসুমে বন বিভাগ জেলে বহরদারদের কাছ থেকে আদায় করে কোটি টাকার রাজস্ব। তবুও এখানকার জেলে ও ব্যবসায়ীদের খাবার পানি, চিকিৎসাসেবাসহ নানা সমস্যায় পড়তে হয়।

‘দুর্গম হওয়ায় এখানে কোনো জেলে বা ব্যবসায়ী রোগাক্রান্ত হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পান না। শহর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় অনেক সময় পৌঁছাতে পৌঁছাতে মারা যান অনেকে। এই তো কিছুদিন আগে সাপের কামড়ে চোখের সামনে এক জেলে মারা গেছে। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি।’

একই উপজেলার জেলে তপন দাস বলেন, ‘খাবার পানি বলতে আমাদের এখানে দুটি পুকুর ও ১৩টি পানির কুয়া রয়েছে। এই কুয়াগুলোর মধ্যে ১০টি কুয়ার পানি ব্যবহারের অনুপযোগী। তিনটি কুয়া থেকে আমরা পানি সংগ্রহ করি। সেগুলোতে অধিকাংশ সময় বিভিন্ন পোকা-মাকড় ও ময়লা-আবর্জনা পড়ে পানি নষ্ট হয়। আমরা পানি সংগ্রহ করে ছেঁকে ও ফিটকারি দিয়ে খেয়ে থাকি।

‘এ ছাড়া যে পুকুর দুটি রয়েছে তার পাড় ভেঙে সাগরের লোনা পানি ঢুকে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে এখানে নেই কোনো আশ্রয়কেন্দ্র। যে ৫টি সাইক্লোন শেল্টার আছে তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগেই। এরপর নতুন কোনো সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ হয়নি এখানে। সব মিলিয়ে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে জেলেদের আশ্রয় নিতে হয় জঙ্গলের ভেতর।’

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বাসিন্দা জেলে জামাল মোল্লা বলেন, ‘সুন্দরবনের এই চরগুলোতে চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, বরগুনা, বাগেরহাট, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার জেলেরা আসেন। সরকারও এখান থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে। কিন্তু সেই তুলনায় আমরা তেমন কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাইনি। বছরের পর বছর ধরে আমরা শুধু আশ্বাস পাই, কিন্তু কাজের কাজ কোনো কিছুই হয় না।’

দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের শুঁটকির মোট চাহিদার ৮০ ভাগ আসে দুবলার চর থেকে। লইট্টা, ছুরি, চিংড়ি, রূপচাঁদা, খলিশা, ইছা, ভেদা, পোঁয়াসহ শতাধিক প্রজাতির শুঁটকি তৈরি করা হয় এই পল্লিতে। শুঁটকি মৌসুম ঘিরে এখানে প্রায় ২৫ হাজার জেলে অবস্থান করেন। এখান থেকেই বন বিভাগ কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোটি টাকা রাজস্ব দিলেও বন বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান না জেলেরা। এ ছাড়া গত বছরের তুলনায় এ বছর বন বিভাগ রাজস্ব নির্ধারণ দ্বিগুণ করেছে। যেটি জেলে ও ব্যবসায়ীদের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখানে পর্যাপ্ত খাবার পানির অভাব রয়েছে, যা আছে তাও ছেঁকে ও বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করে খেতে হয়। এই পানি খেয়ে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় জেলেরা। তখন আবার কোনো সুচিকিৎসা পায় না তারা। এখানে কিছু অস্থায়ী ওষুধের দোকান আছে, চিকিৎসার জন্য ওটাই শেষ ভরসা। এ ছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে নেই কোনো আশ্রয়কেন্দ্র। যে ৫টি সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে, সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। ঝড়ের সময় বাধ্য হয়ে অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেয় অনেকে জঙ্গলে।

‘এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ভারতীয় জেলেদের আক্রমণের শিকার হয় আমাদের জেলেরা। আমাদের জেলেদের জাল ও মাছ লুটে নেয় তারা। এদের ঠেকানের জন্যও নেই কার্যকর কোনো উদ্যোগ। আমি জেলে ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে এখানে খাবার পানির ব্যবস্থা, ভাসমান হাসপাতাল, সাইক্লোন শেল্টার ও জেলেদের নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি।’

অতিরিক্ত আইজি ও নৌ পুলিশ প্রধান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে পরিবার-পরিজন ছেড়ে জেলেরা সুন্দরবনে আসেন। এই পাঁচ মাস দুবলার চর থেকে বিপুল পরিমাণ শুঁটকি আহরণ করা হয়। যা দেশ-বিদেশে বিক্রি হয়। জেলেদের এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুন্দরবন ও জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুবলার চরের আলোরকোলে একটি নৌ পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে জায়গা নির্ধারণ করতে জেলে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের মতবিনিময় হয়েছে। আশা করছি দ্রুত জায়গা নির্ধারণ শেষে আমরা কাজ শুরু করতে পারব। এই ফাঁড়ি স্থাপন করা হলে এখানকার জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।’

বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘১ নভেম্বর থেকে ১৫টি বহরদারের আওতায় ১০ হাজার জেলে সুন্দরবনের বিভিন্ন চরে শুঁটকি আহরণের জন্য অবস্থান করছেন। যেহেতু জেলেরা আমাদের রাজস্ব দিয়ে, পাঁচ মাস সেখানে অবস্থান করছেন, সেখানে তাদের সুপেয় পানি, চিকিৎসাসেবা ও আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজন আছে। আমাদের একটি ইকোট্যুরিজম প্রকল্প আছে, ওই প্রকল্পের আওতায় দুবলার জেলেদের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য একটি নতুন পুকুর খনন করে দিয়েছি।

‘এ ছাড়া একটি পুরাতন পুকুর ছিল, সেটা সংস্কার করে দেয়া হয়েছে। এতে যদি জেলেদের পানির চাহিদা পূরণ না হয়, সে ক্ষেত্রে আমাদের সুরক্ষা প্রকল্প নামের আরও একটি প্রকল্প আছে। ওই প্রকল্পের আওতায় সেখানে আরও একটি পুকুর খনন করে দেয়া হবে। এ ছাড়া সেখানে কিছু কুয়া তৈরি করে দেয়া হয়েছিল, সেখান থেকেও জেলেরা পানি সংগ্রহ করে তাদের চাহিদা মেটাতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে জেলেদের চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন আছে, কারণ দুর্গম এলাকা হওয়ায় জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসাসেবা নিতে জেলেদের শহরে আসতে অনেক সময় লাগে। এ অবস্থায় আমরা সেখানে একটি ভাসমান হাসপাতাল তৈরির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। পাশাপাশি সেখানে চিকিৎসক রাখার ব্যবস্থা করার জন্য বাগেরহাট সিভিল সার্জনকে অবহিত করা হয়েছে।

‘এ ছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে সেখানে যে পাঁচটি সাইক্লোন শেল্টার আছে, সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আমরা ওই ৫টি সাইক্লোন শেল্টার ভেঙে ওই স্থানেই নতুন করে ৫টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। আশা করছি, এই কাজগুলো সম্পন্ন হলে জেলে ও ব্যবসায়ীদের কোনো সমস্যা থাকবে না।’

সূত্র: নিউজবাংলা২৪.কম

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , ,

oceantimesbd.com