একান্ন দিনব্যাপী ‘গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র রিভার ক্রুজের’ যাত্রা শুরু

ভারত ও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে নদীপথে পৃথিবীর দীর্ঘতম ক্রুজের যাত্রা শুরু হয়েছে শুক্রবার ১৩ জানুয়ারি। ভারতের প্রাচীন নগরী বেনারসে গঙ্গার ঘাট থেকে এর ‘ফ্ল্যাগ অফ’ বা সূচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

বেনারসের গঙ্গাতীরে সন্ত রবিদাস ঘাট থেকেই যাত্রা শুরু করেছে ‘এমভি গঙ্গা ভিলাস’ নামের এই প্রমোদতরীটি – পদ্মা-মেঘনা-যমুনা পাড়ি দিয়ে, বাংলাদেশের বুক চিরে যা ৫১ দিনের মাথায় পৌঁছবে ব্রহ্মপুত্রের ধারে ধিব্রুগড়ে।

এই ক্রুজের মোট সোয়া তিন হাজার কিলোমিটার যাত্রাপথে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এটি যাবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে, অথচ এদিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কোনও প্রতিনিধিত্ব ছিল না – যা বেশ অবাক করার মতো।

প্রধানমন্ত্রী মোদী অবশ্য তার ভাষণে একাধিকবার বলেছেন, বাংলাদেশের সহযোগিতাতেই আন্তর্জাতিক জলপথে এই রিভার ক্রুজ সম্ভব হচ্ছে।

ভারতের সরকারি কর্মকর্তারাও জানাচ্ছেন, যাত্রাপথে বাংলাদেশেরও প্রায় ডজনখানেক নদীবন্দরে ভিড়বে এই জাহাজ – সেখানে নেমে যাত্রীরা নানা দ্রষ্টব্য স্থান দেখবেন ও কেনাকাটা করবেন – ফলে লাভবান হবে সে দেশের পর্যটনও।

ভারতের মোট পাঁচটি রাজ্যের ভেতর দিয়ে যাবে এই রিভার ক্রুজ, যার অন্যতম হল পশ্চিমবঙ্গ। ওই রাজ্যের ভেতর দিয়ে ক্রুজের একটা বড় অংশ গেলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও কিন্তু গরহাজির ছিলেন এদিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।

এই মৃদু কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্বস্তির বিষয়টি বাদ দিলে এমভি গঙ্গা ভিলাসের যাত্রাশুরু ছিল রীতিমতো চমকপ্রদ।

একটি বেসরকারি সংস্থার বাণিজ্যিক ক্রুজ অপারেশনের উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে, উপস্থিত থাকছেন বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও সরকারি সব সংস্থার কর্মকর্তারা, সরকারি প্রচারমাধ্যমেও দিনভর এই যাত্রার খবর – এমনটা বেশ বিরল হলেও এদিন কিন্তু এই প্রমোদতরীটিকে ঘিরে ঠিক সেটাই ঘটেছে।

কত ভাড়া, কারা যাচ্ছেন?

এই বিলাসবহুল ক্রুজটি যে দেশি মধ্যবিত্ত বা এমন কী উচ্চ মধ্যবিত্ত পর্যটকদের জন্যও নয়, সেটা নিয়ে অবশ্য অপারেটর কোম্পানি ‘অন্তরা লাক্সারি রিভার ক্রুজেস’ কোনও রাখঢাক করছে না।

ওই সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাজ সিং বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “এর টিকিট যদিও আন্তর্জাতিক ট্র্যাভেল অপারেটরদের মাধ্যমেই বিক্রি করা হচ্ছে, মোটামুটিভাবে ধরতে পারেন ক্রুজে মাথাপিছু প্রতিদিনের খরচ পড়বে পঞ্চাশ হাজার ভারতীয় রুপি বা ছশো মার্কিন ডলার।”

ফলে ৫১ দিনের এই বিলাসবহুল যাত্রায় প্রত্যেক আরোহীর মোট খরচ পড়বে প্রায় তিরিশ হাজার ডলার। স্বভাবতই এটা যে খুব ধনী বিদেশি পর্যটকদের জন্য বানানো হয়েছে , তা বোঝাই যাচ্ছে।

ভারতীয় পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার কথায়, “ভারতীয় রেল রাজস্থানে যেমন ‘প্যালেস অন হুইলসে’র মতো রাজসিক ও বিলাসবহুল ট্রেন চালায়, এটাও অনেকটা সেরকম হাই এন্ড ট্যুরিস্টদের জন্য। বলতে পারেন এই ক্রুজ হল নদীপথের প্যালেস অন হুইলস।”

প্যালেস অন হুইলসেও প্রতি রাতের খরচ পঁচাত্তর হাজার থেকে সোয়া লাখ ভারতীয় রুপি, তবে সেখানে যাত্রাটা সাত থেকে দশ দিনের বলে গঙ্গা ভিলাসের তুলনায় মোট খরচ অনেকটাই কম।

তবে এই বিপুল ভাড়া সত্ত্বেও আগামী প্রায় দুবছরের জন্য এই রিভার ক্রুজের সমস্ত আসনই আগাম বুকড হয়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন রাজ সিং।

উদ্বোধনী যাত্রায় পর্যটকদের সবাই সুইটজারল্যান্ড ও জার্মানির নাগরিক, তবে পরবর্তী ক্রুজগুলোতে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকেও অনেকেই আসন রিজার্ভ করে রেখেছেন।

তিনতলা প্রমোদতরী এমভি গঙ্গা ভিলাসে স্যুইট আছে মাত্র আঠারোটি, ফলে একবারে মাত্র ছত্রিশজন পর্যটক এই ক্রুজে সামিল হতে পারবেন।

আগামী দিনে বারাণসী থেকে কলকাতা এবং কলকাতা থেকে (বাংলাদেশ হয়ে) ডিব্রুগড় – এই দুটো ভাগে যাত্রাপথকে ভাগ করে টিকিট বেচার পরিকল্পনা আছে বলেও জানাচ্ছে অন্তরা রিভার ক্রুজেস।

বাংলাদেশ কি কিছুটা নির্লিপ্ত?

এমভি গঙ্গা ভিলাসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কেন বাংলাদেশের কোনও প্রতিনিধিত্ব ছিল না, সে বিষয়টা অনেককেই বিস্মিত করেছে।

এই যাত্রার বিষয়ে জানতে চেয়ে দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে বিবিসি বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু তাতেও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, “প্রোটোকল রুটে বাণিজ্য, ট্রানজিট বা পর্যটনের জন্য জাহাজ চালানোর অনুমতি তো পরস্পরকে আমরা অনেক আগেই দিয়েই রেখেছি।”

ফলে ভারতের একটি কোম্পানি যদি ভারত সরকারের সহযোগিতায় সেই পথে লাক্সারি ক্রুজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় তাতে বাংলাদেশের নতুন করে আর কিছু করার নেই বলেই ওই কর্মকর্তার বক্তব্য।

তবে ভারতের ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটির চেয়ারম্যান সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় বিবিসির কাছে দাবি করেছেন এই ক্রুজ সফল করে তোলার জন্য তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন।

বেনারসের সন্ত রবিদাস ঘাটে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, “এই ক্রুজের জন্য ওনারা ওদের সবগুলো পোর্ট খুলে দিচ্ছেন, সেখানে পাওয়ার সাপ্লাই করছেন, পানীয় জল সরবরাহ করছেন।”

“এমন কী রাস্তায় যে সব জায়গায় পলি পড়ে সিল্টিং হয়েছে সেখানে ড্রেজিংয়েরও ব্যবস্থা করছেন। ফলে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সবরকমের সাপোর্ট আমরা পাচ্ছি – এটা বলতেই হবে”, জানাচ্ছেন মি বন্দ্যোপাধ্যায়।

অভিজ্ঞতা বলে দক্ষিণ এশিয়ায় রেল, সড়ক বা জলপথে সীমান্ত পেরোনোটা এক ঝকমারি, কিন্তু এই ক্রুজের উদ্যোক্তারা বলছেন কলকাতাতেই পর্যটকদের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের ছাড়পত্র দিয়ে দেবেন বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ।

অন্তরা রিভার ক্রুজেসের রাজ সিংয়ের কথায়, “ভারত ও বাংলাদেশের সব প্রোটোকল মেনে আগেভাগেই যাত্রীদের সীমান্ত পেরোনোর সব কাজ সেরে ফেলা হবে। যাত্রীদের জাহাজ থেকে নামতেও হবে না।”

দু’দেশের সরকারই এই প্রকল্প নিয়ে ‘খুব আগ্রহী ও আন্তরিক’ বলেই সীমান্তেও যাত্রা একেবারেই মসৃণ হবে বলে তাদের দাবি।

ক্রুজলাইনারের ভেতরে যা থাকছে

যাত্রা শুরুর আগের দিন অন্তরা ক্রুজেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৌদামিনী মাথুর বিবিসি বাংলাকে ঘুরিয়ে দেখালেন গঙ্গা ভিলাসের ভেতরে অবকাশ যাপন আর বিনোদনের কী কী আয়োজন রয়েছে।

শিল্পকলার ইতিহাসবিদ অন্নপূর্ণা গ্যারিমেলার কনসেপ্টে এই জাহাজটি তৈরি হয়েছে কলকাতার খুব কাছে শিবপুরের একটি শিপইয়ার্ডে।

শরীরচর্চার জন্য জিম, রোদ পোহানোর সানডেক বা প্যাম্পারিংয়ের জন্য স্পা তো থাকছেই, তবে মিস মাথুর বলছিলেন, “আমাদের অতিথিরা সবচেয়ে বেশি সময় কাটাবেন কিন্তু প্রশস্ত লাউঞ্জেই। সেখানে রোজ রাতে এলইডি স্ক্রিনে মুভি দেখানোর ব্যবস্থা থাকছে, সঙ্গে পপকর্নও!”

প্রথম যাত্রায় পর্যটকরা যেহেতু সবাই প্রায় সুইস ও জার্মান, তাই থাকছে জার্মান ভাষায় বইপত্র, গেমস, পাজ্ল। সঙ্গে ভারতের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ধর্ম নিয়ে কফি টেবিল বুকও।

“সব মিলিয়ে পঞ্চাশ দিন সময়টা মোটেই লম্বা লাগবে না, মিলিয়ে নেবেন!”, হাসতে হাসতে যোগ করেন সৌদামিনী মাথুর।

তিনতলা জাহাজের নানা অংশে থাকছে মূলত সেরামিক আর পিতলের তৈরি নানা ধরনের আর্টওয়ার্ক। ভারতীয় শিল্পকলার তান্ত্রিক ভিস্যুয়ালাইজেশনের আধারে সেগুলো বানিয়েছেন শিল্পী অনিল চন্দ্রন।

মিস মাথুর আরও জানাচ্ছেন, “পুরো জাহাজটা কিন্তু কিউরেট করা হয়েছে কাঁঠাল ডিজাইনের থিমে, আর সরলরেখা আর বড় বড় ব্যালকনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে যত বেশি সম্ভব ওপেন স্পেস।”

“এটা করার কারণ পর্যটকরা যেটা দেখতে এসেছেন সেটাই যেন সবচেয়ে ভালভাবে দেখতে পান কারণ ভুললে চলবে না এই জার্নির আসল তারকা কিন্তু শেষ পর্যন্ত নদীই!”

এই আন্তর্জাতিক মানের রিভার ক্রুজ শেষ বিচারে নদীমাতৃক ভারত ও বাংলাদেশে নদীরই উদযাপন, এরকমটাই দাবি করছেন এই ক্রুজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: ,

oceantimesbd.com