জীববৈচিত্র্য স্বর্গরাজ্য হাকালুকি হাওর, সংরক্ষণে নেই যেন কেউ

বর্ষা ও শীতকাল। ঐতিহ্যবাহী এই হাওর দুই মৌসুমেই ভিন্ন আঙ্গিকে তার রূপ মাধুর্য আর জীববৈচিত্র্যে আকৃষ্ট করে প্রকৃতিপ্রেমীদের। মিঠা পানির মাছ আর জলজ প্রাকৃতিক সম্পদের অভয়াশ্রম হিসেবে খ্যাতি দেশের সবচেয়ে বড় ও এশিয়ার অন্যতম হাওর হাকালুকির।

সিলেট বিভাগের দু’টি জেলার ৬টি উপজেলা (কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ)জুড়ে ছোট-বড় ২৩৮টি বিল নিয়ে এ হাওরের আয়তন ২০ হাজার ৪শ’ হেক্টর। হাওর হাকালুকি শুধু আয়তনে বড় এমনটি নয়। এই হাওরেই স্থায়ী নিবাস দেশীয় বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির নানা জলজপ্রাণি ও উদ্ভিদের। আর এরইসঙ্গে জীবন-জীবিকায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে হাওর তীরের কৃষি, মৎস্য ও শ্রমজীবী প্রায় ৪ লাখেরও মানুষের।

হাওর তীরের মানুষ হাকালুকিতে বোরো ধান, শীতকালীন ফসল চাষাবাদ আর গরু, মহিষ, হাঁস পালন ও মৎস্য আহরণ করেই জীবন চালায়। হাকালুকি হাওরই তাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস। পর্যটন খাতেও রাজস্ব আয়ের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও সঠিক পরিকল্পনা ও অব্যস্থাপনার কারণে বছরান্তে এ খাত থেকে রাজস্ব আয় বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

তবে বিল ইজারায় বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় হলেও হাওরের উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তার সিকিভাগও খরচ না করার অভিযোগ হাওর তীরের উপকারভোগীদের। দিন দিন হাওরের জলজপ্রাণি, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য উজাড় হলেও হাওরটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর বিরুদ্ধে চরম উদাসীনতার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের তরফে।

শুষ্ক মৌসুমে হাওরজুড়ে গরু-মহিষের বাতান, অতিথি পাখির সরব বিচরণ, সরিষা ভুট্টাসহ নানান জাতের সবজি চাষ আর হাওরের বুকে গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য চোখে পড়ে। উল্টো চিত্র বর্ষা মৌসুমে। বিশাল জলরাশির ঢেউ (আফাল, বলন) বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে থই থই পানি।

হিজল, করচ, জারুল, বরুণ, মূর্তাসহ নানা জাতের জলজ গাছগাছালি ডুবন্ত থাকা আর মাছ সংগ্রহে ছোট-বড় নৌকার চলাচলের ব্যস্ততা ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব জানান দেয় হাওর হাকালুকি। জেলায় বছরান্তে ৫০-৫৫ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। মোট উৎপাদনের প্রায় ৫০ ভাগ মাছই উৎপাদন হয় হাকালুকি হাওরের উন্মুক্ত জলাশয়ে। আর বোরো ধান জেলার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার (৪-৫ লাখ মেট্রিক টন) অর্ধেকেরও বেশি উৎপাদিত হয় হাকালুকি হাওরে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, হাকালুকি হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ। ৪১৭ প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি। ১৪১ প্রজাতির অন্যান্য বন্যপ্রাণি। ১০৭ প্রজাতির মাছ, তন্মধ্যে ৩২ প্রজাতির বিভিন্ন পর্যায়ের বিপন্নপ্রায়। রয়েছে নানা ধরনের কীট-পতঙ্গ, জলজ ও স্থলজ ক্ষুদ্র অনুজীব। এখন এই পরিসংখ্যানের অধিকাংশই নেই বললেই চলে। অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দেশের ঐতিহ্যবাহী হাওর হাকালুকি।

সংস্কার না হওয়াতে হাকালুকি হাওর এলাকায় অধিকাংশ বিল, সংযোগ নদী, খাল ও গাঙ্গ এখন ভরাট। তাই শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটে বোরো চাষ হয় ব্যাহত। চরম সংকটে পড়ে বাতানে থাকা গরু-মহিষসহ জলজপ্রাণি ও জীববৈচিত্র্য। আর বর্ষা মৌসুমে নাব্য হ্রাসের কারণে পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় বন্যার ভয়াবহতা ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। হাকালুকির এমন দুর্দশায় হাওর তীরের কৃষি, মৎস্য ও শ্রমজীবী বাসিন্দারা তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায়। হাকালুকি হাওরের বিলের লিজ গ্রহীতা ও স্থানীয় মৎস্যজীবীরা মনে করেন বিলের রক্ষণাবেক্ষণ ও লিজের শর্ত মেনে ন্যূনতম ৩ বছর পর বিল থেকে মাছ আহরণ করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

হাওরে পলিমাটি আসা বন্ধ করা, ভরাট বিলগুলো খনন ও মাছের নার্সারি স্থাপন। নির্ধারিত কয়েকটি স্থানে মাছের স্থায়ী অভয়াশ্রমসহ প্রজনন সময় হাওরে মা ও পোনা মাছ ধরা বন্ধ রাখা। বিষ কিংবা সেচ দিয়ে ও নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে মাছ না ধরা। সময় মতো পোনা মাছ অবমুক্ত করা। মাছ ধরার সময় শামুক, ঝিনুক, শাপলা, শালুকসহ জলজপ্রাণি নষ্ট না করা। তবেই মাছের উৎপাদনের পাশাপাশি সরকারের রাজস্বও বৃদ্ধি পাবে। হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার সঠিক পরিকল্পনা ও স্থায়ী উদ্যোগ নিলে হাওরের অনুপম সৌন্দর্য ও জৌলুস আবার ফিরে আসবে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা।

তারা বলছেন, হাকালুকি হাওরের বিশাল এলাকাজুড়ে ছিল হিজল, করচ, বরুণ, জারুলসহ নানা জাতের জলজ উদ্ভিদের বন। বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণি ও পাখির আবাসস্থলও ছিল এ বনে। ক্রমান্বয়ে বন উজাড় হওয়াতে ঝুঁকিতে পড়ে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য। যে কারণে ১৯৯৯ সালে সরকার হাকালুকি হাওরকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে। হাওরের পরিবেশ রক্ষায় হাকালুকি হাওরের হিজল ও করচের সাড়ে ৭ লাখ চারা লাগানো হয়। সঠিক পরিকল্পনার ও তদারকির অভাব, অযত্ন এবং গরু-মহিষের অবাধ বিচরণ ও বনের গাছপালা কেটে নেয়ায় আবারো ঝুঁকির মুখে পড়েছে হাওরের জীববৈচিত্র্য।

তারা অভিযোগ করে বলছেন, এনজিও সংস্থা হাকালুকির সার্বিক উন্নয়নের নামে দেশ ও বিদেশি নানা সংস্থার টাকা বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে তা বাস্তবায়ন না করেই আত্মসাৎ করে। আর সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো দায়সারা দায়িত্ব পালন করে বাস্তবতার চাইতে কাগজে-কলমে হাকালুকিকে জীবিত রাখার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত।

তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত আন্তরিক প্রচেষ্টা ছাড়া হাকালুকির ঐতিহ্য ও প্রাণ ফেরানো সম্ভব নয়। মৌলভীবাজার জেলা বন্যা প্রতিরক্ষায় প্রেসার গ্রুপের নেতৃবৃন্দসহ সচেতন নাগরিকদের দাবি দেশীয় প্রজাতির মাছ ও জলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মৃত্যু পথযাত্রী হাকালুকিকে বাঁচাতে বন্যপ্রাণি, মৎস্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুত এগিয়ে আসা উচিত। এখন শীত মৌসুমে পর্যটক বাড়লেও অতিথি পাখি কমে যাওয়ার বিষয়ে পাখি বিশেজ্ঞরা বলেছেন, পাখির নিরাপদ আবাসস্থল, খাবার আর পরিবেশ অনুকূলে না থাকলে তারা আসতে চায় না। তারা হাওরে মাছ বৃদ্ধির জন্য বেশি করে গভীর অভয়াশ্রম ও পাখির নিরাপদ নিবাসের জন্য বনায়নের গুরুত্বারোপ করেন। সঠিক ব্যবস্থাপনা আর সর্বোপরি নাব্যতা হ্রাস হওয়া হাকালুকি নাব্যতা ফিরিয়ে দিয়ে জীববৈচিত্র্যে ঐতিহ্য ফেরাতে হবে।

পরিবেশবাদী ও সচেতন মহল বলছেন এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতনতার সঙ্গে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: ,

oceantimesbd.com