ডাইনোসরের ২০ কোটি বছর আগে এসেও পৃথিবীতে টিকে আছে হর্সসু ক্র্যাব

অশ্বক্ষুরের ন্যায় দেখতে উপবৃত্তাকার এ কাঁকড়াটি হলো Horseshoe Crab লিমুলাস। যা “রাজ কাঁকড়া” নামে স্থানীয়ভাবে অনেকের কাছে পরিচিত। নামের সঙ্গে কাঁকড়া থাকলেও প্রজাতিগত দিক থেকে মাকড়সার সঙ্গেই এর মিল রয়েছে লিমুলিডি গোত্রের অন্তর্গত সামুদ্রিক সন্ধিপদি প্রাণীটির। এরা প্রধানত অগভীর সমুদ্র ও নরম বালি বা কাদা সমৃদ্ধ সমুদ্রতলে বাস করে। প্রজননের সময় এরা ম্যানগ্রোভ উপকূলে মাইগ্রেট করে। বিশেষ করে ভরা পূর্ণিমায় সৈকতের কাছাকাছি জোড়ায় জোড়ায় ও দলে দলে বেশি দেখা যায়।

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ডাইনোসর পৃথিবীতে আসার প্রায় ২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে লিমুলাস বা হর্সসু ক্র্যাব-এর আগমন এবং কোন রকম বিবর্তন ছাড়াই টিকে আছে এ সামুদ্রিক প্রাণীটি, যার কারণে এদের লিভিং ফসিল বা জীবন্ত জীবাশ্ম বলা হয়। পৃথিবীতে বর্তমানে চার প্রজাতির হর্সসু ক্র্যাব পাওয়া যায় যাদের তিন প্রজাতি এশিয়াতে আর আমাদের বাংলাদেশের উপকূলে তাদের দুইটি প্রজাতি দেখা যায় বলে বিজ্ঞানীরা প্রাথমিক অনুসন্ধানে বিভিন্ন জার্নালে উল্লেখ করেছেন। এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হল- রক্তের রং নীল বর্ণ।

ফার্মাসিউটিক্যাল পার্সপেক্টিভে এ রক্ত অত্যন্ত মূল্যবান। এদের রক্তে আয়রনের পরিবর্তে তামা বা কপার থাকে যার জন্য এদের রক্তের রঙ নীল হয় এবং এদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের (Hemoglobin) পরিবর্তে হিমোসায়ানিন (Hemocyanin) থাকে। যার কারিশমায় রাজকাঁকড়ার রক্তের শ্বেত কনিকা (amebocytes) যে কোনও ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং বিষাক্ত পদার্থ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। এ কারণে এরা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে তাদের বংশবিস্তার রক্ষা করতে পেরেছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

গবেষণাকালে হর্সসু ক্র্যাব হাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোসলেম উদ্দীন মুন্না

গবেষণাকালে হর্সসু ক্র্যাব হাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোসলেম উদ্দীন মুন্না

নীল রক্তের সংস্পর্শে ক্ষতিকর ব্যকটেরিয়া কার্যকারিতা হারায়। নীল রক্তের অসাধারণ ক্ষমতার কারণে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশেষ করে ভ্যাকসিন তৈরিতে এদের রক্তের গুরুত্ব অপরিসীম। এমনকি সম্প্রতি আবিষ্কৃত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন এর পিউরিটি টেস্ট এর ক্ষেত্রে লিমুলাসের রক্ত কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। হর্সসু ক্রেবের দেহের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে মোট দশটি চোখ যাদের একটির মাধ্যমে তারা অতিবেগুনী রশ্মি শনাক্ত করতে সক্ষম বলে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন।

রাজ কাঁকড়ার চোখের ওপর গবেষণা করে জন হপকিন্স স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক ড. এইচ কে হার্টলাইন (Haldan Keffer Hartline) ১৯৬৭ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫০ সালের দিকে কেফার হার্টলাইন বিশ্লেষণ রাজ কাঁকড়ার বিস্ময়কর চোখ নিয়ে গবেষণায় দেখিয়েছিলেন কীভাবে ভিজ্যুয়াল কোষ থেকে প্রাথমিক সংকেতগুলি স্নায়ুকোষের নেটওয়ার্কে প্রক্রিয়া করা হয়। তিনি আরও দেখিয়েছিলেন যে, যখন একটি কোষ উদ্দীপিত হয়, তখন আশপাশের কোষ থেকে আসা সংকেতগুলি নিরুদ্ধ হয়ে পরে যার কারণে কন্ট্রাস্টের ধারণা বোঝা খুব সহজ হয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে হর্সসু ক্র্যাব হতে বাণিজ্যিকভাবে (Limulus Amebocyte Lysate) উৎপাদন ও বাজারজাত করা হয়। আবার আমাদের মত দেশে মৎস্য শিকারসহ বিভিন্ন কর্মযজ্ঞের কারণে এ মূল্যবান কাঁকড়া ও তাদের বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে অহরহ। প্রয়োজনীয় আইন ও প্রটেকশন ব্যবস্থা না থাকায় এদের ডিম ও বাচ্চা নষ্ট হচ্ছে। কুকুর ও পাখির খাবার হিসেবে এদের বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন কারণেও মূল্যবান এ সম্পদটির অস্তিত্ব বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে পড়েছে। তাই প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের অন্যতম সদস্য, বিস্ময়কর মূল্যবান প্রাণীটি সংরক্ষণ ও বিলুপ্তি হতে রক্ষা করতে আমাদের সকলের সচেতনতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবী।

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , ,

oceantimesbd.com