এক দিনে মাত্র ৪০ মিটার পথ চলে

বিচিত্র এক পৃথিবী। প্রাণিজগতের অন্যতম ধীরগতির প্রাণী স্লথ।স্লথ মূলত দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার ক্রান্তীয় বনাঞ্চলের বাসিন্দা। এরা তাদের ধীর গতির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এতোটাই ধীরে নড়াচড়া করে যে পশমের ওপর রীতিমতো অ্যালজি বা শৈবাল গজিয়ে যায়। এতে অবশ্য স্লথের কোনো সমস্যা হয় না। বরং সুবিধা। নিশাচর বিড়াল শ্রেণির শিকারী প্রাণী বা হার্পি ঈগলের হাত থেকে লুকাতে বেশ কাজে দেয় এই হালকা সবুজ শ্যাওলার স্তর।

কোনো কোনো স্লথ দিনে মাত্র ৪০ মিটার পথ চলে। অর্থাৎ প্রায় অনড় অবস্থায় কাটিয়ে দেয় ঘন্টার পর ঘন্টা। এ কারণে, প্রাকৃতিক এই ছদ্মবেশ তাদের দারুণ কাজে আসে। গাছের চেয়ে মাটিতে এদের গতি আরও কম। একমিনিট হাত-পা নাড়ালে স্লথ, মোটামুটি ৪ মিটার পর্যন্ত এগোতে পারে। এটাই এদের সর্বোচ্চ গতিসীমা। যে কোনো শিকারি প্রাণীর তুলনায় এ গতি খুবই সামান্য। বিজ্ঞানীদের মতে স্লথের ধীরগতির পেছনে একটা বড় কারণ হলো, এর খাদ্যাভাস।

মূলত দুই ধরণের স্লথ আছে। একধরণের স্লথের পায়ে তিনটি আঙুল, অন্য ধরনের স্লথের আছে দুইটি আঙুল বিশিষ্ট পা। এদেরকে বলা হয়, ওমনিভেরাস বা সর্বভুক। যার অর্থ এরা উদ্ভিদ এবং প্রাণী উভয়ই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।

তিন আঙুল বিশিষ্ট স্লথকে বলা হয় ফলিভেরাস বা ফলভোজী। এরা শুধু গাছে পাতা ও ফুল খেয়ে জীবন ধারণ করে। অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর মতো শেকড় বা কাণ্ড এদের খাদ্য তালিকার মাঝে পড়ে না।

এ ধরনের খাদ্যভাস জীবজগতে খুব একটা দেখা যায় না। সবমিলিয়ে প্রায় ১০০ প্রজাতির প্রাণী আছে, যারা গাছে বাস করে এবং শুধু পাতা ও ফুল খেয়ে জীবন ধারণ করে।

স্লথের মতোই ধীরগতি সম্পন্ন ও ফলিভেরাস ধরনের আরেক প্রাণী, কোয়ালা। অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে এদের দেখা পাওয়া যায়। স্লথের মতো কোয়ালারও আছে গাছে চড়ার উপযোগী শক্ত ধারাল থাবা। দিনের বেলা প্রায় পুরো সময়ই ঘুমিয়ে কাটায় এরা। রাতে বেশি সক্রিয় থাকে। পাতা খাওয়ার কাজটিও এ সময়ে সারে তারা।

কোয়ালা বা তিন আঙুল বিশিষ্ট স্লথের মতো ফলিভেরাস ধরনের প্রাণীর সংখ্যা পৃথিবীতে খুবই কম। এর কারণও খাদ্যাভাস। গাছের পাতায় পুষ্টিগুণের পরিমাণ খুবই সামান্য। তাই এ থেকে যে শক্তি পাওয়া যায়, তাও খুব সামান্য। যার অর্থ, কোয়ালা এবং স্লথের মতো প্রাণীরা খুব অল্প শক্তি ব্যবহার করে জীবনধারণ করতে সক্ষম।

এতো কম শক্তির খাবার ব্যবহার করে বেঁচে থাকার উপায় একটাই। নড়াচড়া কম করা এবং দীর্ঘসময় বিশ্রাম নেওয়া। কোয়ালা এ কারণেই দিনের প্রায় ২০ ঘন্টা সময় বিশ্রাম ও ঘুমের মাঝে কাটায়।

স্লথের তুলনায় কোয়ালা অনেক পরিশ্রমী। কিন্তু সেটা হয় খুব অল্প সময়ের জন্য। প্রতিদিন গড়ে একটি কোয়ালা মাত্র ১৯০ মিটার পথ পাড়ি দেয়। তবে, এখন পর্যন্ত একদিনের কোয়ালার সর্বোচ্চ ২৫০০ মিটার পথ পাড়ি দেওয়ার রেকর্ড আছে। শীতনিদ্রায় যায় না এমন প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে কম শক্তি ব্যবহার করে তিন আঙুল বিশিষ্ট স্লথ। স্থলে কিংবা গাছের চেয়ে জলপথে এদের গতি কিছুটা বেশি থাকে। লম্বা পা এদের এই অতিরিক্ত সুবিধাটুকু দেয়।

পৃথিবীজুড়ে ক্রমাগত বন উজারের কারণে অন্যান্য প্রাণীদের মতো স্লথ ও কোয়ালাও বিপর্যস্ত। যেহেতু এদের গতি কম, তাই অন্য প্রাণীদের থেকে এদের বিপদটাও বেশি। বন উজারের কারণে নিজের বাসস্থান পরিবর্তনের জন্য দূরের পথ পাড়ি দিতে হয় এদের। এই দীর্ঘ পথের যাত্রার জন্য তাদের শরীর যেমন উপযুক্ত না, তেমনি পথে বিড়াল জাতীয় শিকারি প্রাণীদের হাতেও থাকে অরক্ষিত।

এজন্য পৃথিবীতে দিনদিন কমে আসছে স্লথের সংখ্যা। বিশেষ প্রজাতির তিন আঙুল বিশিষ্ট পিগমি স্লথকে ‘গুরুতরভাবে বিপন্ন’ ঘোষণা করা হয়েছে। এর অর্থ, একে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তেমন কিছুর করার সুযোগ নেই।

কোয়ালাও একই পরিমাণ বিপদে আছে। অস্ট্রেলিয়াতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ গাছ কাটা পড়ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশটির নিউ সাউথ ওয়েলস বনাঞ্চল থেকে কোয়ালার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে।

কোয়ালা এবং স্লথের মতো ধীরগতি প্রাণীদের বাঁচাতে বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি কাজ করতে হবে সাধারণ মানুষকেও। পৃথিবী নামের এই গ্রহটা বাসযোগ্য রাখতে হলে সকল প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরী। বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে এই দায়টুকু শুধু মানুষের কাঁধেই বর্তায়।

সূত্র: দ্য কনভার্সেশন

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags:

oceantimesbd.com