জলবায়ুর যন্ত্রণায় বিপন্ন উপকূলের নারী জীবন

শামিমা নাসরিন বিউটি। বয়স যখন ২৫ বছর তখন থেকে ভুগছেন জরায়ুর সমস্যায়। অন্তত ১৫ বছর সয়ে শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালে বাধ্য হন জরায়ু ফেলে দিতে। মায়ের কষ্ট না কাটতেই এখন একই সমস্যায় ভুগছেন তার ২১ বছর বয়সী মেয়ে। হার্টের রোগ নিয়ে বেকার স্বামীও। তাই সব সংকট যেন ঘিরে ধরেছে এই নারীকে।

শামিমা কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘জরায়ু কাটার আগে ব্যথায় বিছানায় ছটফট করতাম আমি। স্বামীর টাকা না থাকায় বহুদিন ভুগতে হয়েছে আমাকে। জরায়ু কেটেও আমি সুস্থ্য নয়।

এখন মেরুদণ্ডে ব্যথায় কোনো কাজ করতে পারি না। জরায়ু কাটার পর থেকে অসুস্থতার কারণে কাজ করতে না পারা এবং স্বামীর চাহিদা পূরণ করতে না পারায় স্বামীও ভালো চোখে দেখেন না। সংসারে অশান্তি লেগেই আছে। আমি দোয়া করি আমার মতো কারো যেন এই অবস্থা না হয়।’

নিজের মেয়েও একই রোগে আক্রান্ত জানিয়ে সরকারের কাছে সুপেয় পানি এবং সুচিকিৎসার দাবি করেন শামিমা।

এই সমস্যা যে শুধু শামিমার তা নয়। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন ঘুরে অসংখ্য নারীর কাছ থেকে একই অভিযোগ পাওয়া যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমবর্ধমান লবনাক্ত পানির কারণেই এই পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন বলে মনে করেন এইসব নারীরা।

শামিমার প্রতিবেশী বিলকিস আক্তার বলেন, ‘আমি ৯ বছর আগে জরায়ু কাটিয়েছি। এখনো আমার বহু ওষুধ খেতে হয়। শুধু জরায়ুর জন্যই প্রতিদিন ৭৫টাকার ওষুধ খাই। সংসারের যে আয় তা দিয়ে ওষুধ চালানো এবং কাজ করতে না পারা নিয়ে ঘরে নিয়মিত দ্বন্দ লেগেই থাকে।’

তাদের পাশের বাড়ির ১৫ বছর বয়সী কিশোরী নাম প্রকাশ না করে জানান, গত দুই বছর ধরে তিনি লিউকোরিয়া রোগে ভুগছেন। মাঝে মাঝে ব্যথায় ছটফট করতে হয় তাকে।

তানিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার জরায়ুতে প্রচুর ব্যথা হয়। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। ডাক্তার অপারেশন করতে বলেছেন। কিন্তু আমি এখনো করাইনি। ডাক্তার এখন আমাকে পুকুরের গোসল করতে নিষেধ করেছেন। কারণ পুকুরের পানির মাধ্যমেই এটা হচ্ছে।’

এইসব নারীদের অভিযোগের বাস্তবতা খুঁজতে ইউনিয়নের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে গিয়ে জানা যায়, সেখানকার ৬০ শতাংশের বেশি নারী যৌনিপথে চুলকানি, লিউকোরিয়া ও সারাগায়ে র‌্যাশ ওঠাসহ পানিবাহিত নানান রোগ নিয়ে আসেন।

গাবুরা ইউনিয়নে সরকারিভাবে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক না বসলেও এনজিও ব্রতী সমাজকল্যাণ সংস্থার পরিচালিত ভাসমান একটি হাসপতাল রয়েছে। এই সংস্থাটি প্রতি মাসে প্রতিটি গ্রামে একটি করে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ক্যাম্প করে।

এসব ক্যাম্পে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এসে রোগী দেখেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও জানতে সংস্থাটির কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিগত তিন বছরে এই হাসপাতালে জলবায়ুজনিত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নিয়েছেন ৯ হাজার ২৫৯ জন নারী রোগী।

শুধু গত ডিসেম্বর মাসে সংস্থাটির কাছ থেকে স্বাস্থ‌্যসেবা‌ নি‌য়ে‌ছে ৭৬৮ জন রোগী। তার ম‌ধ্যে নারী রোগী ছিলেন ২৮৬ জন। যার ১০৪ জনই ছিলেন গর্ভবতী। বাকি নারীদের মধ্যে জরায়ু ইন‌ফেকশনের রোগী ছিলেন ২৩ জন।

শুধু তাই নয়, শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই হাসপাতালে প্রতিদিন অন্তত দেড় থেকে ২শ’ নারী চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে ৪০ ভাগেরও বেশি নারী লিউকোরিয়া বা জরায়ু সমস্যায় ভুগছেন। যার ৮ থেকে ১০ শতাংশই ইতোমধ্যে ফেলে দিয়েছেন জরায়ু।

তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরায়ু অপারেশন হয় না। অধিকাংশ অপারেশন হয় বেসরকারি হাসপতালগুলোতে। শ্যামনগর উপজেলায় ৮টি বেসরকারি ক্লিনিক রয়েছে। যার ৩টি থেকে রোগী ভর্তির তথ্য নিয়ে জানা যায়, এসব ক্লিনিকে ২০২২ সালে ৭২৩ টি সার্জারি হয়েছে। যার মধ্যে জরায়ু অপারেশন হয়েছে ৭৮টি।

লবনাক্ত পানির সঙ্গে জরায়ু সমস্যার সম্পর্ক কতুটুক বুঝতে লবনাক্ততা নেই দেশের দুই প্রান্তের এমন দুটি উপজেলার বেসরকারি হাসপাতাল থেকেও তথ্য নেই আমরা। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের আবেদীন হাসপাতাল থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই হাসপাতালে ২০২২ সালে ৭২১টি সার্জারির মধ্যে জরায়ু অপারেশন হয়েছে ২০টি। অপরদিকে উত্তরের জনপদ রংপুরের পীরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ২১ জন রোগীর জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়লেও কারো অপারেশন করাতে হয়নি। যা এই সমস্যার সঙ্গে লবনাক্ততার সম্পর্কের ইঙ্গিত করছে।

দুর্গম এলাকা হওয়ায় সাধারণত গাবুরা ইউনিয়নের নারীরা যে কোনো সমস্যা নিয়ে আগে যান কমিউনিটি ক্লিনিকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিয়নের ডুমুরিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার হেলেনা বিলকিস বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক নারী আমার কাছে আসেন যোনিপথে চুলকানি এবং সাদা স্রাব নিয়ে।

এই চিকিৎসা আমাদের কাছে না থাকায় আমরা উপজেলায় যেতে বলি। কিন্তু এইসব নারীরা কারো কাছে বলতে না পারায় ঘরোয়া চিকিৎসা বা গ্রাম্য চিকিৎসক থেকে চিকিৎসা নিয়ে বসে থাকেন। অনেকে ব্যথার ওষুধ খেয়েও কাটিয়ে দেন। এক পর্যায়ে এদের অনেককেই জরায়ু কেটে ফেলতে হয়।’

‘এই সমস্যার মূল হলো লবনাক্ত পানি। তারা ১৫ থেকে ২০ পরিবার এক পুকুরে গোসল করে। সেই পুকুরে গরু-ছাগলও গোসল করে। এর মাধ্যমে রোগ ছড়ায়। তাছাড়া, যখন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয় তখনতো পুকুরেও লবন পানি ঢুকে পড়ে। তখন এইসব নারীরা সেভাবে পরিচ্ছন্ন হতে পারে না’-বলছিলেন, কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার হেলেনা বিলকিস।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ফাতিমা ইদ্রিস ইভা বলেন, ‘উপজেলা হাসপাতালে প্রতিদিন যে পরিমান রোগী দেখি তার অন্তত ৫০ ভাগ নারী রোগীই লিউকোরিয়া বা জরায়ুর কোনো না কোনো সমস্যা নিয়ে আসেন। এদের অনেকে আক্রান্ত হয়ে আসেন।

আবার কেউ কেউ আতঙ্কেও আসেন। তবে যে পরিমান রোগী আসে তার ৪০ থেকে ৫০ ভাগকে আক্রান্ত অবস্থায়ই পাওয়া যায়। ৮ থেকে ১০ শতাংশ নারী জানান তার জরায়ু ইতোমধ্যে কেটে ফেলেছেন।’

এই সমস্যার কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে এখানকার নারীদের যোনিপথে ইনফেকশনের প্রধান কারণ পরিচ্ছন্নতার অভাব। এরা হাইজিং ম্যান্টেন করেন না। করতে না পারারও কারণ আছে। কারণ, তাদের পানির চরম সংকট। বহুদূর থেকে পানি আনতে হয় তাদের। সেই পানি খাবে না ব্যবহার করবে এসব কারণে তারা পরিচ্ছন্নতায় পানি কম ব্যবহার করে।’

লজ্জায় প্রাথমিক পর্যায়ে কাউকে না বলা ও চিকিৎসা না নেওয়ায় সমস্যা প্রকট আকারে পৌঁছায় বলেও মনে করেন এই গাইনি বিশেষজ্ঞ।

শুধু জরায়ু সমস্যা নয়, রয়েছে চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানান সমস্যা। এসব সমস্যায় পারিবারিক আয় ও ব্যয়ের বৈষম্য তৈরির পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে নানা সংকট। বাড়ছে পারিবারিক কলহও। ফলে উপকূলের নারীরা স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়ছেন বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নারী ইউপি সদস্য ফরিদা পারভীন বলেন, ‘আমাদের এখানো জলবায়ুর কারণে সুপেয় পানির সংকটে কিশোরী নারীদের নানান সমস্যা হচ্ছে। একটা মেয়ের বয়স ১৮ হওয়ার আগেই তার শরীরে র‌্যাশ উঠে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, রঙ জ্বলে যাচ্ছে, চুল পেকে যাচ্ছে। জরায়ু সমস্যাতো আছেই। এসব কারণে মেয়েরা সাবালিকা হলেই তাদের বাল্যবয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়।’

‘বিয়ের আগ থেকে যার জরায়ু সমস্যা বিয়ের পর তার সেটা আরও বেড়ে যায়। এদের সাংসারিক জীবনে কারো একটা বাচ্চা হচ্ছে কারো বাচ্চা হচ্ছে না। এসব কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রচুর ঝামেলা। এর কারণে আমাদের শতকরা ৪০ শতাংশ মেয়ে বিয়ের পর বাবার বাসায় চলে আসে। আর বিবাদ মিমাংসার জন্য আমাদের কাছেও প্রতি মাসে ৩ থেকে ৫টা অভিযোগ আসেই’ বলছিলেন, ইউপি সদস্য ফরিদা পারভীন।

গাবুরা ইউনিয়নের মানুষ বিশেষ করে নারীরা জলবায়ুজনিত নানান কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দাবি করে ইউপি চেয়ারম্যান জি এম মাসুদুল আলম বলেন, ‘আমরা যে পরিমান ক্ষতিগ্রস্ত সেই হিসেবে আমাদের জন্য বরাদ্দ আসে না। নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা নারীর উন্নয়নে কোনো বরাদ্দ দেখাই যায় না। অথচ জলবায়ুর কারণে যেসব ক্ষতি হচ্ছে তার অনেকগুলোই পুরুষ মোকাবিলা করতে পারলেও নারীর জন্য এটা খুবই কঠিন।

যেমন- জলোচ্ছ্বাসের পরে লবনপানি ঘরে ঢুকে পড়লে পুরুষ যে কোনো স্থানে গিয়ে তার প্রাকৃতিক কাজ সারতে পারে, নারীতো সেটা পারে না। এভাবেই নারীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদের গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ প্রকল্প বরাদ্দ খুবই দরকার।’

এ বিষয়ে জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসাইন খান বলেন, ‘নারীরা এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এটা নিয়ে জেলা প্রশাসন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কারো পক্ষ থেকেই কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এটা নিয়ে দ্রুত কিছু করা না হলে নারীরা খুব অল্প সময়ে তাদের উৎপাদনশীলতা হারাবে, সেখানকার জন্মহার কমে যাবে, নারীদের কর্মক্ষমতা কমে যাবে, যেসব বাচ্চা জন্ম নিবে তারা প্রতিবন্ধী হতে পারে একইসঙ্গে সেখানে ক্যান্সারের হার বেড়ে গেলে জলবায়ু তাড়িত এসব মানুষের ওপর মরার ওপর খড়ার ঘা হিসেবে ব্যায়ের ভার এমন বাড়বে যা তারা চিকিৎসা করতে পারবে না নিজেদের সুস্থ রাখতে পারবে।’

পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রাথমিক পর্যায় থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহনের পাশাপাশি এ বিষয়ে গবেষণাও জোর দেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন এই জলবায়ুবিদ।

-বাংলাভিশনে প্রকাশিত

সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।

Tags: , , , ,

oceantimesbd.com